আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের তিন সপ্তাহ পার হলেও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো কার্যকর অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতারা এখন একসুরে ইউরোপকে দায়ী করছেন শান্তি প্রক্রিয়ার স্থবিরতার জন্য। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধের কৌশল ও কূটনৈতিক চাপের টানাপোড়েনের মধ্যে এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
বৃহস্পতিবার (০৪ সেপ্টেম্বর) ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেন, যুদ্ধ থামাতে ইউরোপকেই আরও দায়িত্ব নিতে হবে। অথচ এখন পর্যন্ত সীমিত অগ্রগতি হয়েছে মূলত ইউরোপের কূটনৈতিক উদ্যোগেই, যেখানে তাঁরা যুদ্ধ-পরবর্তী ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছেন।
এর আগের দিন হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ট্রাম্প জানান, তিনি শিগগিরই আবার পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন। তবে রাশিয়া যদি বারবার নির্ধারিত সময়সীমা অমান্য করে শান্তি উদ্যোগে অগ্রসর না হয়, তবে তিনি কড়া পদক্ষেপ নেবেন কি না—সে ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি। তাঁর ভাষায়, ‘যদি আমরা খুশি হই, ভালো। খুশি না হলে, তখন কিছু একটা ঘটতে দেখবেন।’
বৃহস্পতিবার তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন। আলোচনায় অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো ও রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থায়ন ঠেকানো নিয়ে আলোচনা হয়। তবে বৈঠকের পর হোয়াইট হাউসের বার্তায় ইউরোপকেই বেশি দায়ী করা হয়।

হোয়াইট হাউস জানায়, ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, ইউরোপকে অবিলম্বে রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে হবে। শুধু গত এক বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কিনেছে ১.১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যে। পাশাপাশি ইউরোপকে চীনের ওপরও অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে বলেছেন ট্রাম্প, কারণ চীন রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থায়নে ভূমিকা রাখছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য আংশিকভাবে যৌক্তিক হলেও বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর অবস্থান অনেকাংশে সাংঘর্ষিক। তিনি ইউরোপকে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বললেও নিজে বেইজিংয়ের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দিতে অনিচ্ছুক। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় আছে, যেখানে ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ জটিলতা তৈরি করেছে। তাই তিনি এমন কিছু করতে চাইছেন না যা আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভারতের ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের অবস্থান বিতর্কিত। রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ না করায় তিনি ভারতের রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। এতে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে চীনকে ভারতের কাছাকাছি আসার সুযোগ দিয়েছে। এর প্রমাণ মিলেছে এই সপ্তাহেই, যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আন্তরিকভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান। এদিকে মোদিকেও দেখা গেছে পুতিনের গাড়িতে ঘুরতে, যা তিন সপ্তাহ আগের ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের স্মৃতি উসকে দিয়েছে।

রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধে ইউরোপের ওপর ট্রাম্পের চাপ হয়তো চূড়ান্ত ফল দেবে না। কারণ ইউরোপ ইতোমধ্যেই রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে ইউরোপের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। এখন সমুদ্রপথে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ও শোধিত তেল আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ইইউ। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে ইউরোপে রাশিয়ান তেল আমদানি ছিল ১৬.৪ বিলিয়ন ডলার; ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা নেমে এসেছে মাত্র ১.৭২ বিলিয়ন ডলারে।
এদিকে রাশিয়া ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা জোরদার করেছে। চীন সফরে গিয়ে পুতিন স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোকে পাশে নিয়ে বলেন, ইউরোপ ‘অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে’। তাঁর দাবি, রাশিয়ার ইউরোপ আক্রমণের কোনো ইচ্ছাই নেই। অথচ বাস্তবে রাশিয়া ২০১৪ ও ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছিল।
আলাস্কার বৈঠকেও পুতিন ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে ইউরোপকে হুঁশিয়ার করেছিলেন যেন তারা কূটনৈতিক উদ্যোগে ‘বাধা না দেয়’।
এ সপ্তাহে ইউরোপীয় কমিশন অভিযোগ করেছে, রবিবার বুলগেরিয়ায় অবতরণের সময় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লায়েনের বিমানের জিপিএস সিগন্যাল বিঘ্নিত করা হয় এবং এর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। মস্কো অবশ্য এটিকে ‘ভুয়া’ ও ইউরোপের ‘ভীতি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
আরেকটি বার্তায় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনে বিদেশি সেনা মোতায়েনের চিন্তাধারা রাশিয়ার কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য’। এটি ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব নস্যাৎ করার আরেকটি প্রচেষ্টা।
পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। হোয়াইট হাউস আগে আশা প্রকাশ করেছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে এ বৈঠক হতে পারে। পুতিন অবশ্য মস্কোয় বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু জেলেনস্কির পক্ষে তা সম্ভব নয়। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আরেকটি অজুহাত মাত্র।

প্রথমদিকে ট্রাম্প নিজেকে আলোচনার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরে তিনি আবার রাশিয়ার অবস্থানকেই সমর্থন করছেন, যেখানে দুই নেতার একান্ত বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে। ইউক্রেনের মিত্ররা আশঙ্কা করছে, এতে পুতিন এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন যা দিয়ে তিনি ট্রাম্পকে বোঝাতে চাইবেন যে আলোচনায় বাধা দিয়েছেন জেলেনস্কিই।
তবুও বৃহস্পতিবার একটুখানি অগ্রগতি হয়েছে। ট্রাম্প, জেলেনস্কি ও ইউক্রেন মিত্রদের মধ্যে আলোচনার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন, ২৬টি দেশ যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে।
ম্যাক্রোঁ বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনটি দিক গুরুত্বপূর্ণ—ইউক্রেন সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা, ইউরোপীয় সেনা মোতায়েন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতা। মার্কিন প্রশাসনও শর্তসাপেক্ষে এই নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখার আগ্রহ দেখিয়েছে।
তবুও সপ্তাহজুড়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে ট্রাম্পের হতাশা বাড়ছে, তবে বড় কোনো সমাধান তিনি এখনো তুলে ধরতে পারেননি।
পতাকানিউজ/এনটি

