সম্পাদকের টোকা :
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে এই বাংলায় প্রথম কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা, সেই তথ্য নিশ্চয় অনেকের জানা। নোবেল প্রাইজে পাওয়া অর্থের একটা বড় অংশও তিনি এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছিলেন। নওগাঁ জেলার পতিসরে ১৯০৫ সালে ‘কৃষি সমবায় ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার পর সেখানকার কৃষকেরা দারুণ উপকৃত হচ্ছিলেন। কিন্তু সরকারের আচমকা প্রণিত একটি আইনের কারণে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়।
তবে ব্যাংকিং ইতিহাসে কবিগুরুর এই মহান উদ্যোগের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটান তাঁরই দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি আবার বাংলার প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু এই ব্যাংকটির ভরাডুবি ঘটে এই দাদা ঠাকুরেরই অপশাসনে। বলা যায়, ইনিই বাংলার প্রথম ‘ব্যাংক-লুটেরা’। আর তাঁর সেই ব্যাংকটির নাম ছিল ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’।
প্রিয় পাঠক, এবার নিশ্চয় ধরতে পেরেছেন, ‘এরশাদে শুরু, হাসিনায় সারা’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে হঠাৎ কেন কবিগুরুর বংশ ধরে টান দিলাম। তাঁর সেই বিখ্যাত গান ‘তোমার হলো শুরু / আমার হলো সারা’ থেকেই শিরোনামটির আইডিয়া আসে। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের সাথে তাঁর দাদা সূচিত ‘ব্যাংকডুবি’ শব্দবন্ধেরও মিল রয়েছে। আমাদের এই প্রতিবেদনটাও ইউনিয়ন ব্যাংক নিয়ে; তবে সেটা কবিগুরুর দাদারটি নয়; আমাদের ব্যাংক-লুটেরাদের গুরু এস আলমেরটি নিয়ে। কাকতালীয়ভাবে এস আলমের ব্যাংকটির নামও ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’।
এবার আসুন, দেখে নিই, বাংলাদেশের এই নব্য ইউনিয়ন ব্যাংকটি কীভাবে ফোকলা হয়ে গেলো; আমানতকারীদের ১৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা সাবাড় করা হলো; আর অন্যান্য ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের ৭ হাজার ৫২১ কোটি টাকার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে গেলো। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ২৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা ঋণের বড় অংশই বেনামি কোম্পানির আড়ালে নিয়ে গেছে এস আলম গং। ব্যাংকটির ৯৮ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি, ভাবা যায়! এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাবো, আসলে জনগণের টাকা লুটপাটের নীলনকশা করেই ইউনিয়ন ব্যাংকটি বানানো হয়েছিলো।
.
সবার আগে জানা দরকার- কীভাবে জন্ম হয় একটি ব্যাংকের।ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, সরকার কোনো ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিলে সেটার প্রাথমিক মূলধন জোগান দেয় রাষ্ট্র তথা জনগণ। পরে আবার আমানতও জমা করে জনগণ। অর্থাৎ, সরকারি ব্যাংকের পুরোটাই জনগণের টাকায়। আর বেসরকারি ব্যাংকের বেলায় সর্বশেষ নিয়ম অনুযায়ী, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করতে হয় কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা; একেকজনকে ১ কোটি বা তার গুণিতক; তবে কোনো ব্যক্তি, তার পরিবার বা ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখা যাবে না।
কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাংকের বেলায় ঘটেছে যেন ‘কিসের আইন?’
আইন ভেঙ্গে অশুভযাত্রা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০১১ সালে নতুন নতুন ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রথমে বলা হয়, তিনটি নতুন ব্যাংক দেওয়া হবে। তবে আওয়ামী লীগপন্থী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের ঠেলাঠেলিতে শেষ পর্যন্ত ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী (প্রয়াত) আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’ এ কারণেই নতুন ব্যাংকগুলো পরিচিতি পায় ‘রাজনৈতিক ব্যাংক’ হিসেবে এবং এগুলো যে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাতেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেটাও আলোচিত হয়। এগুলোরই একটি ইউনিয়ন ব্যাংক।
২০১১ সালে এসব ব্যাংক দেওয়ার আলোচনার সময় এস আলম তৎকালীন প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অতোটা পরিচিত ছিলেন না। সে-সময় এস আলমের পরিচিতি ছিল বিএনপি–জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ী হিসেবে। বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সাথে এস আলমের ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে। সেই থেকে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত এস আলমই দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান।

নতুন ব্যাংকগুলো নিয়ে আলোচনাকালে প্রায় সবারই ধারণা ছিল, ইউনিয়ন ব্যাংক জাতীয় পার্টিঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। এই ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নাম ছিল। তাই ধারণা করা হয়েছিল, এরশাদই হবেন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তবে ২০১৩ সালে ব্যাংকটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর সব খোলাসা হয়। দেখা যায়, চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার এস আলম ওরফে মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের ভাই শহিদুল আলমকে চেয়াম্যান এবং এস আলমের জামাতা বেলাল আহমেদকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
সেসময় ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক গঠন করতে হলে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিতে হবে। এই অর্থ সম্পূর্ণ কর-পরিশোধিত কি না, তাও নিশ্চিত হতে হবে। আর উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ যে ঋণ, কর বা সরকারের কোনো বিলখেলাপি না, সেটাও নিশ্চিত হয়ে তারপর লাইসেন্স দিতে হবে। আর একক ব্যক্তি বা পরিবার বা ব্যবসায়ী গ্রুপ কোনো একটি ব্যাংকে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখতে পারবে না। কিন্তু এই আইনকে তুচ্ছ করেই যাত্রা শুরু হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই ইউনিয়ন ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ারের মালিকানা যায় সরাসরি এস আলম পরিবারে। ব্যাংকটির ২৬ জন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারের অন্তত ২০ জনই ছিলেন সরাসরি এস আলম পরিবারের সদস্য বা তাদেরই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাকুরে।
ব্যাংক খাতের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এরকম গুরুতর অনিয়ম ঘটাতে এস আলমকে সহায়তা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী এবং ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরে দুই ধাপ পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী পরিচালক থেকে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া) আনোয়ারুল ইসলাম। হাসিনা সরকারের পতনের পর সুর চৌধুরীকে জেলে দেওয়া হলেও আনোয়ারুল ইসলাম রহস্যজনকভাবে প্রকাশ্যেই আছেন।
নিজেরা নিজেরাই উদ্যোক্তা
ওই ২৬ জন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ২০১৩ সালে মোট ৪২৮ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়। ঢাল হিসেবে সামনে রাখা হয় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব (প্রয়াত) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর দ্বিতীয় স্ত্রী মেহেজেবুন্নেসা রহমান টুম্পাকে। এছাড়া পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস, অবেসরে যাওয়া সচিব মো. খায়রুল ইসলামের ছেলে মোরসালিন ইসলাম সৌরদীপকেও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার করা হয়। এরশাদ, টুম্পা ও সৌরদীপের শেয়ারের টাকাও এস আলমই দিয়েছিলেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ব্যাংকটির অনুমোদন সহজ করতেই এটা করা হয়।
এদের বাইরে এস আলমের ভাই শহিদুল আলম ও জামাতা বেলাল আহমেদ ছাড়াও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হন– এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ছেলে আহসানুল আলম, ভাই রাশেদুল আলম, ভাই আব্দুস সামাদ লাবুর স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, আরেক ভাই ওসমান গনির স্ত্রী ফারজানা বেগম, শ্যালক মো. আরশাদ, দুই ভাগ্নে মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ আদিল ও সারওয়ার জাহান মালেক।
এছাড়া এস আলম পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট আশিক আহমেদ, মারজিনা শারমিনের নামও থাকে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে। এর বাইরে এস আলম গ্রুপের ম্যানেজার আরিফ আহমেদ, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক মর্তুজা সিদ্দিক চৌধুরী, সিটিজেন ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সালমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েব এবং জনৈক এসএম আনোয়ার সাদাতও ছিলেন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার।
এছাড়া ইউনিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটিজের প্রতিনিধি হিসেবে মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন এফসিএ, লায়ন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পক্ষে মাহমুদুল আলম, সিঅ্যান্ডএ ফেব্রিকসের খন্দকার ইফতেখার আহমেদ, সিঅ্যান্ডএ এক্সেসরিজের মো. আব্দুল ওয়াদুদ, ক্রিস্টাল ব্রিজ প্রাইভেটের শাহেদুল হক, ওশিয়ান রিসোর্টের প্রতিনিধি হিসেবে শওকত হোসাইন এফসিএর নাম ছিলো উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারের তালিকায়। এগুলো যে এস আলমেরই বেনামি প্রতিষ্ঠান, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেও বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আরো বের করেন, এস আলমের ব্যাংকটির অনুমোদের পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এই সুরের সাথে এস আলমের গাটছড়া বেঁধে দেন আরেক অর্থ লুটেরা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। পি কে তখন এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আভিভা ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন। পরে তাকে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি করা হয়।
ঘরের শাখায় ‘ডাকাতি’
লুটপাটের নীলনকশা চূড়ান্ত করে শুরু হয় চিরায়ত ব্যাংকিং ব্যবসা- জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ এবং তা থেকে ঋণ বিতরণ। দেখতে দেখতে ২০২৪ সালের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকে আমানত জমে যায় ১৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এরপর শুরু হয় ঋণ বিতরণের নামে টাকা লুটপাট। ঘরের কাছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখাতেই ঋণ বিতরণ হয় ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা বা ৯৯ দশমিক ৩৮ শতাংশই এখন খেলাপি। এই এক শাখাতেই বিতরণ করা ঋণের (২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা) ৯৪ শতাংশেরই সুবিধাভোগী এস আলম; যা কি না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চলতি অর্থ বছরের বাজেটের চেয়েও বেশি। অস্বিত্বহীন ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে এই টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও সেটা বের হয়।
শুধু তাই না, খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ব্যবসা উন্নয়ন খরচের নামে দুই বছরে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে গতবছরের জুলাই সময়ে শাখা ব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে প্রতি মাসে নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে অন্তত ২৫ লাখ টাকা করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে একক লেনদেনে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত নগদ উত্তোলন দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাস্কফোর্স টিম ব্যাংকের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পেয়েছে যে, শাখা ব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে বেনামে এ টাকা বের করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জালিয়াতি-খেলাপিতে শীর্ষে
সারা দেশে ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট শাখা রয়েছে ১১৪টি; আর উপশাখা রয়েছে ৬০টি। এর অনেকগুলো থেকে এস আলম গ্রুপ অন্তত সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে ভুয়া ২৪৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ঋণসীমা ছিলো ১১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা; অথচ দেওয়া হয়েছে ১৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। অবিশ্বাস্য রকমের জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে অনেক। যেমন, ঢাকায় ব্যাংকটির পান্থপথ শাখায় এস আলমের একজন কর্মচারীর নামেই ১১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বের করা হয়েছে। আবার ৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার ১৯টি মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ৮৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা; এমনকি কোনো আমানত না থাকার পরও ঋণের নামে এক হাজার ১৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বের করে নেয়া হয়েছে।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী, আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ঋণ দেওয়া যায়; আর শরীয়াহ ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯২ শতাংশ। কোনো ধরনের মঞ্জুরিপত্র ছাড়াই এসব শাখা থেকে বিতরণ হয়েছে ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। মঞ্জুরীপত্র ছাড়াই অনুমোদন মানে, প্রধান কার্যালয় বা আঞ্চলিক কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ঋণ দেওয়া, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। আবার মঞ্জুরীপত্র থাকলেও ২২২ জন গ্রাহকের নামে মঞ্জুরিসীমার চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে (৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা) এবং পতাকানিউজ হিসাব মিলিয়ে দেখেছে, এই টাকা দিয়ে লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো আরেকটা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা যায়।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্ঘাটনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। গতবছরের অক্টোবরে ব্যাংকটির বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) ঘাটতি ছিল ৬৭৭ কোটি এবং আগস্ট শেষে বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) ঘাটতি ৬১০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি বন্ডে বিনিয়োগ করা পুরো ৪৯৭ কোটি টাকা লিয়েন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে।
এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধমে ইউনিয়ন ব্যাংক নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চে ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ২৮ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ঋণের ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক কেপিএমজির রিপোর্টে উঠে এসেছে, ব্যাংকটির ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ ঋণই খেলাপি। এসব টাকা আর ফেরত আসছে না। অথচ আতঙ্কের কারণে জমানো টাকা তুলে নিতে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে আমানতকারীদের মাঝে। এ কারণে ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত উঠেছে ১১৯ দশমিক ৪২ শতাংশে, যেখানে শরীয়াহভিত্তিক এরকম একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে।

ওদিকে ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রথম দিকের ২০টি শাখার ১০১ জন গ্রাহকের নামে সৃষ্ট ঋণের বন্ধকি সম্পত্তির তথ্য যাচাই করতে গিয়েও মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, এই ১০১ জন গ্রাহকের ঋণের বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য দেখানো হয়েছিল ৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত মূল্য মাত্র ২৫৫ কোটি টাকা। এর মানে বন্ধকি সম্পত্তির দর ২৭ গুণ বেশি দেখিয়ে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।
ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টে কারসাজি
প্রতিটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে একটি চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এক বলে ‘ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট’। এই অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্যাংকটির সিআরআর, এসএলআর সংরক্ষণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া পুনঃঅর্থায়নসহ যাবতীয় লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। আরও সহজভাবে বললে, আপনি চেক বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যখন আরেক ব্যাংকের গ্রাহককে টাকা দেন, তখন সেটা সরাসরি যায় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতা লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকের ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টে সেই টাকা পরিশোধ করলে তখন সেটা গন্তব্যে যায়। নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকটির ওই অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলে লেনদেন হবে না। অথচ, ২০২১-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের এই ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা থাকা তো দূরের কথা, উল্টো মাইনাস করে রাখারও সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কীভাবে, শুনবেন?
নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি শরীয়াহ ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে। কোনো অবস্থাতেই আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। গত মার্চে ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত কমে ১৮ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এর ৯২ শতাংশ হলেও সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারার কথা। কিন্তু ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ২৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি- সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ নিজেরাই। পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাবেই, ওই টাকা দিয়ে দেশের সব দরিদ্র মানুষের ২ মাসের খাবারের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রশ্ন হলো, আমানতের চেয়ে যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ দিলো, এই বাড়তি টাকা ব্যাংকটি পেলো কোথায়?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলে, ইউনিয়ন ব্যাংক আন্তঃব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে ৫ হাজার ১২১ কোটি টাকা আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এক হাজার ৪৩৮ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ধার হিসেবে দিয়েছে আরও ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এরকম অবৈধ সুযোগ ইউনিয়ন ব্যাংক কীভাবে পেলো?
এই প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মন্তব্য, এস আলম গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ৬টি ব্যাংক থেকে বিপুল টাকা বের করে নেয়। পরে সেই ব্যাংকগুলোতে বিপর্যয় শুরু হলে প্রথম দিকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে আসা দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিলো। তবে একইভাবে লুটপাটের কারণে ২০২২ সালের শেষদিকে ইসলামী ব্যাংকের নিজেরই দুরবস্থা শুরু হলে এস আলমের অন্য ব্যাংকগুলো মহাসংকটে পড়ে যায়। ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে ব্যাংকগুলো সিআরআর, এসএলআর সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে কোনো ব্যাংক সিআরআর, এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হলে জরিমানা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও ঘাটতি হলে পরিচালনা পর্ষদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করতে হবে; এক পর্যায়ে পর্ষদ সদস্যদেরকে ব্যক্তিগতভাবে জরিমানাও করতে হবে।
কিন্তু এসব করা তো দূরের কথা, উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংক অনৈতিক উপায়ে ইউনিয়ন ব্যাংকের ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টটি ঋণাত্বক রেখে সেখানে টাকার জোগান দিতে থাকে। এখানে আবারো স্মরণযোগ্য, এসবই কিন্তু রাষ্ট্রের, মানে জনগণের টাকা।
গোপন করা হয় আসল চিত্র
ইউনিয়ন ব্যাংকের অবস্থা আরো আগে থেকেই খারাপ বলে জানা যাচ্ছিল। তবে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানান কৌশলে প্রকৃত অবস্থা আড়ালে রাখা হয়। ২০২২ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ গুণগত মানে খেলাপিযোগ্য। অথচ ব্যাংকটি ওই সময় ২২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি দেখিয়েছিল ৭২৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।
একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পারলে অন্য সব সূচক ভালো থাকে। কারণ, খেলাপি ঋণ বাড়লে আয় কমে যায়। তখন ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি হয়। মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে ব্যাংকটি তখন লোকসানে পরিণত হয়। লভ্যাংশ দিতে পারে না।
আবার অনেক আগ থেকেই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার অবস্থায় ছিল না ব্যাংকটি। কিন্তু ওই সময় আইন লংঘন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাব ঘাটতি রেখেই লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়। এর মানে, ব্যাংকটির হিসাব খালি থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছিলো, যে কারণে আমানতকারীরা কিছু বুঝতে পারেননি।
ডাকুরা পালিয়ে, দুজন ধরা
ইউনিয়ন ব্যাংকে এস আলমের অনিয়ম-জালিয়াতির মূল দোসর ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আব্দুল কাদের। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দু’জনই পলাতক। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদও সপরিবারে দেশের বাইরে চলে গেছেন। এদের সবার ফোন বন্ধ। যে কারণে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অন্য দুই দোসরের একজন, দেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার মামলার আসামি পি কে হালদারকে ২০২২ সালের মে মাসে আটক করে ভারতের পুলিশ। আর এস কে সুর চৌধুরীকে গত ১৪ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে দুদক।
এতদিনে অ্যাকশন
বাংলাদেশ ব্যাংক গতবছর ২৭ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালন পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে। ব্যাংকটির এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবিরকে। পতাকানিউজকে তিনি বলেন, ব্যাংকটিতে নানান অনিয়ম ঘটেছে। এখন আমরা চাচ্ছি, ব্যাংকে শৃংখলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের আস্থা ফেরাতে। সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করলে হয়তো সেটা সম্ভব হবে।
এছাড়া সাবেক সচিব মো. খায়রুল ইসলামের ছেলে মোরসালিন ইসলাম সৌরদীপের কাছে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের ৫৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত। দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৫ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।
এছাড়া, আওয়ামী লীগ আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এস আলমের প্রভাবে ইউনিয়ন ব্যাংককে যেসব অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছিল, সরকার পতনের পর সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। আমানতকারীদের রোষানল থেকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত নভেম্বরে ইউনিয়ন ব্যাংককে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ‘বিশেষ ধার’ দিয়েছে।
পতাকানিউজ/টিআর

