৩৭ বছর বয়সী বুর্কিনা ফাসোর সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রায়োরে নিজেকে এমন এক প্যান-আফ্রিকান নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যিনি দেশকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নতুন ঔপনিবেশিকতার শেকল থেকে মুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার বার্তা আফ্রিকা জুড়ে এবং বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছে। অনেকের কাছে তিনি বুর্কিনা ফাসোর বিপ্লবী নেতা টমাস সানকারার উত্তরসূরি যিনি “আফ্রিকার চে গুয়েভারা” নামে পরিচিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা কন্ট্রোল রিস্কস-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক বেভারলি ওচিয়েং বলেন, “ট্রায়োরের প্রভাব বিশাল।” তার মতে, ট্রায়োরের বার্তা বর্তমান বাস্তবতা প্রতিফলিত করে, যখন আফ্রিকানরা প্রশ্ন তুলছেন কেন এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য রয়ে গেছে এবং পশ্চিমা সম্পর্ক কতটা ন্যায্য।
২০২২ সালের অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় এসে ট্রায়োরের সরকার সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জোট গড়ে। এর মধ্যে রুশ সেনা মোতায়েন ও বামপন্থী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি রাষ্ট্রীয় খনিজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, বিদেশি কোম্পানিকে স্থানীয় কার্যক্রমে ১৫ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার শর্ত দেন এবং স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন বাধ্যতামূলক করেন। এপ্রিলের শেষ দিকে রুশ কোম্পানি নরডগোল্ডকে স্বর্ণ খনির নতুন বিনিয়োগের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
তার কথিত ‘বিপ্লব’-এর অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো জাতীয় স্বর্ণভাণ্ডার গঠন, স্বর্ণ শোধনাগার নির্মাণ এবং খনিজ সম্পদ থেকে দেশীয় লাভ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পশ্চিমা মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো চাপে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক সারামা রিসোর্সেস ২০২৪ সালের শেষ দিকে অনুসন্ধান লাইসেন্স বাতিলের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সালিশি শুরু করে। লন্ডন-তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির দুটি স্বর্ণখনি জাতীয়করণ করা হয়েছে, এবং সরকার আরও বিদেশি খনি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর গবেষক ইন্নক র্যান্ডি আইকিন্স বলছেন, এই র্যাডিকাল সংস্কার আফ্রিকায় তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে-“তিনি এখন আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয়, যদি প্রিয়তম নাও হন।”
২০২৩ সালের রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে ট্রায়োরে আফ্রিকান নেতাদের উদ্দেশে বলেন, “সাম্রাজ্যবাদীদের সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো নাচা বন্ধ করুন।” রুশ গণমাধ্যম এই বক্তৃতা ব্যাপক প্রচার করে। সম্প্রতি তিনি মালি ও নাইজারের সামরিক নেতাদের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকীতে রাশিয়ায় যোগ দেন এবং “সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের” প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।
আফ্রিকান-আমেরিকান ও কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশদের মধ্যেও তার প্রতি সমর্থন দেখা গেছে। মার্কিন র্যাপার মিক মিল এক পোস্টে তার “এনার্জি ও হৃদয়” প্রশংসা করলেও নাম ভুল করে তাকে ‘বুর্কিনা ফাসো’ বলে সমালোচিত হন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাকে “আত্মঘোষিত প্যান-আফ্রিকানদের সঙ্গে নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের বারোক জোট”-এর অংশ বলে মন্তব্য করেছেন এবং রাশিয়া-চীনকে আফ্রিকায় অভ্যুত্থান উসকে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
তবে সমালোচকেরা বলছেন, ট্রায়োরে ১০ বছরের ইসলামপন্থী বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটিকে দমন করছেন। সমালোচক ডাক্তার ও বিচারকদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংকট গ্রুপের রিনালদো ডেপাগনে বলেন, দেশের তরুণ নেতা হিসেবে তিনি জনপ্রিয়। “তিনি গণমাধ্যমে দক্ষ, অতীত ব্যবহার করে সানকারার পুনর্জন্মের চিত্র আঁকেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে আশার কথা বলেন।”
ঘানার নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রফেসর কওসি আনিং বলেন, পশ্চিম আফ্রিকায় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা কমায় ট্রায়োরের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আফ্রোবারোমিটারের ২০২৪ সালের জরিপে ৩৯টি দেশে গণতন্ত্রের সমর্থন কমেছে, যদিও এটি এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঘানার প্রেসিডেন্ট জন মাহামার অভিষেকে যুদ্ধ পোশাকে কোমরে পিস্তল নিয়ে হাজির হয়ে ট্রায়োরে সবার নজর কাড়েন। আনিং বলেন, “২১ জন রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত থাকলেও ট্রায়োরে আসার পর পুরো পরিবেশ বদলে যায়।”
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক জানায়, কঠিন নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২৫ সালে অর্থনীতি শক্তিশালী থাকবে এবং দারিদ্র্যের হার ২৪.৯ শতাংশতে নেমেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ডের প্রধান জেনারেল মাইকেল ল্যাংলি অভিযোগ করেছেন, ট্রায়োরে স্বর্ণভাণ্ডার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করছেন। এই মন্তব্যে তার সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজধানীতে বিশাল সমাবেশ করে, যা লন্ডনসহ বিদেশেও সমর্থন পায়।
ট্রায়োরে মালি ও নাইজারের সঙ্গে ফরাসি সেনা বহিষ্কার করেছেন, ইকোওয়াস থেকে বেরিয়ে নতুন জোট গড়েছেন এবং বিদেশি পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—স্থায়ী উত্তরাধিকার গড়তে হলে তাকে শান্তি প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
বিবিসি-
পতাকানিউজ/এসকে

