ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ফলাফল শুধু ছাত্ররাজনীতির পালাবদল নয়, বরং জাতীয় নির্বাচনের দিকনির্দেশনায়ও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা।
ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগরে শিবিরের জয়কে অনেকে ইসলামপন্থার উত্থান হিসেবে দেখছেন। সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক আড্ডায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ‘শিবির নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পাস’। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবতা আরও সূক্ষ্ম। এটি হয়তো হঠাৎ করে আদর্শগত ঝোঁক নয়, বরং তরুণ ভোটারদের কৌশলগত ভোট প্রয়োগের প্রতিফলন।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে কৌশলগত ভোট সুপরিচিত ধারণা—যেখানে ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে নয়, বরং সম্ভাব্য বিজয়ীকে বেছে নেন, যাতে তাদের ভোট বৃথা না যায়। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরের নির্বাচনে অনেক শিক্ষার্থী সরাসরি বলেছেন, শিবিরকে সমর্থন না করলেও তাদের ভোট দিয়েছে, কারণ কেবল তারাই জিততে পারবে বলে মনে হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিদায়ের পর দীর্ঘ ছাত্রআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল মূলত শিবির। তারা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, হল দখলে রেখেছে এবং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা গত এক বছরে দিকহীন অবস্থায় থেকেছে। এই প্রেক্ষাপটেই শিবিরকে অবশ্যম্ভাবী শক্তি হিসেবে দেখেছে অনেক তরুণ।
জাতীয় রাজনীতিতেও একই চিত্র। তরুণদের চোখে বিএনপি হয়ে উঠছে শেখ হাসিনা-পরবর্তী সরকারের একমাত্র কার্যকর বিকল্প। সংগঠন, সম্পদ ও ঐতিহাসিক ভিত্তি—সবকিছু মিলিয়ে তাদেরকে ক্ষমতাসীন হওয়ার উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর জরিপে দেখা গেছে, ৩৮.৮ শতাংশ তরুণ মনে করছেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হবে। জামায়াত পেয়েছে দ্বিতীয় অবস্থান, ২১.৫ শতাংশ তরুণের সমর্থন নিয়ে। যদিও এই ধারণা বাস্তবে কতটা সঠিক তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবু এটি প্রথমবারের ভোটারদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে।
যেভাবে ক্যাম্পাসে শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি তাদের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরেছে, জাতীয় পর্যায়ে বিএনপির প্রতিচ্ছবি তৈরি হচ্ছে তেমনভাবেই। অর্থহীন ভোটের ভয় তরুণদের ছোট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে দূরে রাখছে। ফলত বিএনপি যত বেশি অজেয় মনে হচ্ছে, ততই তাদের দিকে ভোটাররা ঝুঁকছেন।
এটি রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভাষায় ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রোফেসি’—যেখানে সম্ভাব্য বিজয়ের ধারণাই বাস্তবে জয়ের পথ সুগম করে।
বাংলাদেশের জেনারেশন জেড ভোটাররা বেড়ে উঠেছে এমন এক সময়ে যখন নির্বাচনকে অনেকেই প্রহসন বলে মনে করত। আওয়ামী লীগের টানা শাসনে ছোট দলগুলোর জায়গা ছিল সংকুচিত। এই প্রেক্ষাপটে তরুণরা আদর্শ নয়, বাস্তব ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটের কার্যকারিতা।
সামাজিক মাধ্যম ও সহপাঠী প্রভাবের কারণে তারা বাস্তব সময়ে হিসাব-নিকাশ করছে। এই প্রবণতা ক্যাম্পাসে যেমন শিবিরকে এগিয়ে দিয়েছে, জাতীয় পর্যায়েও বিএনপিকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।
বাম দলগুলো বা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) কিছুদিন নিজেদের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও সাম্প্রতিক ব্যর্থতা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। তরুণ ভোটারদের চোখে এ ধরনের ভোট এখন ‘অপচয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বিএনপি বনাম অন্য সবাই।
বিএনপির জন্য সবকিছু জেতা জরুরি নয়। তাদের কেবল এই ধারণা টিকিয়ে রাখতে হবে যে তারাই একমাত্র দল যারা ক্ষমতায় যেতে সক্ষম। এই বিশ্বাসই তরুণ ভোটারদের কৌশলগত হিসাব-নিকাশে তাদের পক্ষে ভারী করে তুলতে পারে।
ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, জাতীয় পর্যায়েও একই চিত্র দেখা দিতে পারে। আর সেটিই হয়তো বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির বড় মোড় ঘোরানো বাস্তবতা হয়ে উঠবে।
পতাকানিউজ/এনটি

