নগরীর দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পটু আর অপটু হাতে করা যেসব রঙিন ছবি ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী লেখা ও আঁকাআঁকি একসময় যাকে বলত চিকামারা আর আধুনিককালে তাই কি গ্রাফিতি?
এককালের ‘দেওয়াল লিখন’ কথাটি বর্তমানে চিকা মারা নামে পরিচিত। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গাছের ডাল ভেঙে এর আগা থেঁতলিয়ে ব্রাশের ন্যায় তুলি বানাত। নিচে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের আগায়ও যাতে স্লোগান লেখা যায় সে জন্য তুলিগুলো করা হতো লাঠির মতো লম্বা। সে সব ব্রাশ বা তুলিতে আলকাতরা লাগিয়ে দেওয়ালে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হতো। গ্রেপ্তারের ভয়ে সাধারণত রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে দেওয়ালে এ সব স্লোগান লেখা হতো।
এরপর থেকে ‘দেওয়াল লিখন’ লিখতে গেলে শিক্ষার্থীরা বলত চিকা মারতে যাচ্ছে। এভাবে ‘দেওয়াল লিখন’ বাগ্ভঙ্গিটি ‘চিকা মারা’য় পরিণত হয়। এখন শুধু দেওয়ালে নয়, রাস্তাতেও চিকা মারা হয়।

ইতিহাস পড়লে জানা যায়, ১৯৬৮ সালের ১০ মে প্যারিসের রাস্তায় ছাত্রদের ওপর চালানো পুলিশের তাণ্ডবে স্তম্ভিত হয়ে যায় ফ্রান্সের মানুষ। এ সময় ফরাসি ভাষায় চিত্রিত করে দেয়ালে লেখা হয়েছিল এই ছন্দময় বাক্যাংশটি। এই পংক্তির আগে দেয়ালে লেখা ছিল, ‘Abolish alienation./Obedience begins with consciousness;/ First, disobey; then write on the walls. / (Law of 10 May 1968)’।
ইতালীয় শব্দ ‘গ্রাফিও’ (‘স্ক্র্যাচ’) থেকে সৃষ্ট শব্দ গ্রাফিতি। শব্দটি বহুবচন, তবে প্রায়শই একবচন হিসেবে ব্যবহার হয়। সবাই দেখতে পায়- এমন জায়গায় অনুমতি ছাড়াই লেখা বা আঁকা হলে তা গ্রাফিতি। দেয়ালে লেখা বা আঁকার ইতিহাস সুদীর্ঘ। প্রাচীন রোমান ধ্বংসাবশেষ, মধ্য আমেরিকার তিকাল নামের মায়া শহরের অবশেষে,স্পেনের ১৬শ শতাব্দীর পাথরে এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজি চার্চে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
প্রাচীন রোমে গ্রাফিতি রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবেও কাজ করত। সম্রাটদের নীতি, সিদ্ধান্ত, এবং শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে গ্রাফিতিতে প্রায়ই ব্যঙ্গ করা হতো।
কবিতার মতো প্যারিসের দেয়ালের এই লেখাটি ‘গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প’ বইয়ের লেখক বীরেন দাশশর্মা ভাষান্তর করেছেন এইভাবে, ‘বিচ্ছিন্নতা দূর করো।/মান্যতার শুরু চেতনায়। চেতনার শুরু অমান্যতায়। / প্রথমেই, অমান্য করো; তারপর লেখো দেওয়ালে। / (১০ মে, ১৯৬৮-র আইন) / দেওয়ালে লিখতে আমার ভালো লাগে না।/ধুর,যেখানে পারো, লেখো।’

তবে, প্যারিসে দেয়ালে লেখা কোনও অসম্ভব দাবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তো নয়-ই, ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কোনও ‘অসম্ভবের দাবি’ নয়, তিনি শুধু আহ্বান করেছেন তার লেখা এই কবিতার প্রথম দুই পংক্তিতে, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় লেখা হয়েছিল ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। পত্রিকায় ছাপানো যায়নি এই কবিতাটি। উত্তাল সময়ে ভীতিকর পরিবেশে গভীর রাতে ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে আহমদ ছফা ও হুমায়ূন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে স্লোগান হিসেবে লিখলেন সেই কবিতার প্রথম দুই লাইন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দুই লাইনের এই পংক্তির সেই উদ্দীপনা এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে আজও দেয়ালে লেখা হয় এই কবিতা— এক জীবন্ত স্লোগান।
দেয়ালে রঙ দিয়ে স্লোগান লেখা এই ‘চিকামারা’র চল বাংলাদেশে প্রথম শুরু হয় ১৯৬২ সালে। ড. মোহাম্মদ হাননানের লেখা ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগান রাজপথে লিখছিল ছাত্র-নেতৃবৃন্দ।
ওই রাতে দেয়ালে লেখা হলো, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘Down Ayub’, ‘পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না’। প্রথম এই চিকামারা হয়েছিল ঢাকা হলের পূর্বপাশে রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে টি অ্যান্ড টি’র একটি দেয়ালে। ইন্দোনেশিয়ায় এসব দেয়াল লেখার প্রচলন ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত সেই ছবি দেখে ঢাকায় এই প্রথম দেয়াল লিখনের অনুপ্রেরণা বলে মনে করা হয়।

১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিকে এগুতে গিয়ে সভা-সমাবেশে সবার কণ্ঠে স্লোগান উঠল, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এরপর ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের স্লোগান, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
তবে ২০২৪ এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে দেশে গ্রাফিতির এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষে জুলাইয়ের প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল বিবর্ণ। দেয়াল জুড়ে আঁকা হয়েছে আন্দোলনের গৌরবময় গ্রাফিতি। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। একে স্মরণীয় করে রাখতেই শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ। গ্রাফিতিতে রয়েছে তাদের রক্তের দাগ। বৈষম্যবিরোধী প্রতিবাদ, গণঅভ্যুত্থানের চিত্র। রাষ্ট্র সংস্কারের কথা, বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প। অসাম্প্রদায়িক বাংলার দৃশ্য।
দুর্নীতি, অত্যাচারের অবসান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, পরবর্তী প্রজন্মের প্রত্যাশাসহ আরো অনেক অনেক কিছু। শিক্ষার্থীদের আঁকা শিল্পকর্ম নজর কেড়েছে। প্রায় সবাই এর প্রশংসা করেছে। রক্তাক্ত জুলাইকে তারা গ্রাফিতিতে তুলে এনেছে। বাংলাদেশের শহরগুলো যেন স্লোগান আর স্লোগানের গ্রাফিতিতে রঙিন হয়ে উঠেছে। দেয়াল জুড়ে প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে – ‘বুকের ভিতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘গর্জে উঠেছিলাম বলেই বাংলাদেশে’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফেরত দে’, ‘বিকল্প কে – আমি, তুমি আমরা’, ‘ছিনিয়ে এনেছি বিজয় শিখিনি পরাজয়’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা ৩৬শে জুলাই’, ‘শোন ধর্ম আর দেশকে মিলাইতে যেও না, ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চূড়া’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’, ‘আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না’, ‘আমরা গড়ব আমাদের দেশ’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই’, ‘নাটক কম করো পিও’ ইত্যাদি স্লোগানের গ্রাফিতিতে ছেয়ে যায় বাংলাদেশ।
কেবল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভবনের দেয়াল নয়, সীমানাপ্রাচীর, সড়কদ্বীপ, মেট্রোরেল ও উড়ালসড়কের স্তম্ভসহ কোথায় নেই গ্রাফিতি। এসব গ্রাফিতিতে রয়েছে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাহসিকতার প্রতীক আবু সাঈদের প্রতিকৃতি। আবু সাঈদের যে কত প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে এর যেন শেষ নেই। আছে মুগ্ধের প্রতিকৃতি। মুগ্ধের পানির বোতলের গ্রাফিতিও আছে। বাংলাদেশের দেয়াল যেন আজ রক্তাক্ত জুলাই।
ইতিহাসের এক অনন্য আন্দোলন হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। এটি বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠন। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এটি সৃষ্টি হয়। প্রথমে কোটা সংস্কার ও পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ৮ই জুলাই ৬৫ সদস্যের কমিটি হয়। এদিকে দিন যতই যায় ততই আন্দোলন দুর্বার গতি ধারণ করে। এরই মধ্যে অনেক মামলা-হামলার ঘটনা ঘটে। কেউ আহত হয়, কারো মৃত্যু হয়, কেউ গুম হয়।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ হয়ে আসছে। সে-সময় কামরুল হাসান এই ধারা শুরু করেন। তারপর নব্বইয়ের গণআন্দোলন পর্যন্ত শিল্পীরা গ্রাফিতি এঁকেছেন। সেই থেকে দেশের যে-কোনো আন্দোলনে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। দেয়ালে কিছু উপস্থাপন করলে মানুষকে সেটা আকর্ষণ করে। তাই প্রতিবাদের একটা অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গ্রাফিতি। এই মুহূর্তে দরকার, জনগণের সরকার, অমুক ভাইকে ভোট দিন, অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, এই মার্কায় ভোট দিন, সেই মার্কায় ভোট দিন– এভাবে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বক্তব্য, স্লোগান, ব্যক্তিগত কষ্টের কথা গ্রাফিতিতে এসেছে।

গ্রাফিতির ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তায় সাধারণ মানুষেরা তাদেরকে কী করা উচিত, সে সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করে এবং অন্যদিকে ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের ভুল সম্পর্কে সতর্কবার্তা পায়। গ্রাফিতি শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সমস্যাকেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন করে আঁকা হয়, এমনটা নয়। অনেক সময় সমাজে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা নির্মম রীতিকেও নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সমাজের রীতিনীতিকে প্রশ্ন করায় গ্রাফিতির আর্টিস্টদের জুড়ি মেলা ভার। একটি সমাজে সিংহভাগ মানুষ কোনো নির্মম প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে, দলগতভাবে অন্যায়কে প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে যেতে পারে। গ্রাফিতি আর্টিস্টরা এ ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ ভাষায় সেসবকে আক্রমণ করেন।
প্রতিটি গ্রাফিতি সমকালীন জীবনবোধ থেকে উৎসারিত হয়ে সমকালীন বিভিন্ন সংকট ও সমস্যাকে তুলে ধরে। বিশ্ব জুড়ে গ্রাফিতি যেভাবে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে, তা আমাদের আশাবাদী চোখের দৃষ্টিসীমাকে আরও প্রসারিত করে।
গ্রাফিতি- এক ভিন্নধর্মী চিত্রাঙ্কন মাধ্যম। বৈশিষ্ট্যে, রঙে, আঁকার ঢঙে, দ্যোতনায়- সবকিছুতেই তা চলমান যে কোনো ছবির চেয়ে আলাদা। জল বা তৈলচিত্র, কিংবা চারকোল পেইন্টিংয়ের চেয়েও দ্বিগুণ শক্তিতে যেন নজর কাড়ে গ্রাফিতি। দেয়ালে দেয়ালে উজ্জ্বল রঙের বিভিন্ন অর্থবহ পথচিত্র অঙ্কনের পেছনে উদ্দেশ্য থাকে সংগ্রাম কিংবা হিংস্রতার বদলে দেশের মাধুর্য এবং কারুশিল্পের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ। গোটা পৃথিবীকে ব্যবহার করা যায় গ্রাফিতির ক্যানভাস হিসেবে, আবার সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার ফলে গ্রাফিতি সবারই চোখে পড়ে, সবাই এর দর্শক।
লেখক: চিত্রশিল্পী ও গণমাধ্যম কর্মী

