শুরুটা হয়েছিল খুব সাধারণভাবে—টেলিগ্রাম অ্যাপে অপরিচিত এক বিদেশি নারীর মেসেজে। ইংরেজিতে শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজেকে পরিচয় দিলেন ‘সিনথিয়া’, ‘বাইরা রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি’র প্রতিনিধি বলে দাবি করলেন। এরপর ইংরেজিতে বলেন, আপনার জন্য একটি ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে। ঘরে বসেই দিনে কয়েকহাজার টাকা উপার্যন করা যাবে। আপনি কাজ করতে ইচ্ছুক হলে ‘হ্যাঁ’ লিখুন। অন্যথায় লিখুন ‘না’। ‘হ্যাঁ’ লিখে থাকলে তিনি জানাবেন, আপনার সঙ্গে অতিসত্তর যোগাযোগ করা হবে। এভাবেই ফাঁদ পাতে প্রতারক চক্র।
সোহেল রানা (ছদ্মনাম) তখনো জানতেন না, এই এক ‘হ্যাঁ’ লেখাই তাঁকে এক ভয়াবহ প্রতারণার জালে ফেলে দেবে—যার পরিণতিতে তিনি হারাবেন প্রায় ১৪ লাখ টাকা। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ও বিকাশ নম্বর উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। এতে ‘ইজি পোস্ট ২০০১ ব্যাচ’ নামে অনলাইন প্লাটফর্মকে আসামি করা হয়।
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জীনাত সুলতানা শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে মামলার তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ট্রাইব্যুনালের পিপি সেলিম উদ্দিন শাহীন।
ফাঁদ পাতার প্রথম ধাপ
মেসেজের ২–৩ দিন পর আরেকটি টেলিগ্রাম আইডি থেকে যোগাযোগ। এবার প্রেরক পরিচয় দিলেন ‘লগিওয়ে’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে। দাবি করলেন, তারা আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের কাজে যুক্ত, আর পণ্যের প্রমোশনে অংশগ্রহণকারীদের মুনাফার অংশ দেওয়া হয়। শুরুতে দেওয়া হলো একটি ওয়েব পোর্টাল লিংক। নির্দেশ—২৫–৩০টি পণ্যের রেটিং করতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকাশে এলো ৬০০–৭০০ টাকা। এই ‘প্রথম লাভ’ ছিল প্রতারকদের বিশ্বস্ততা অর্জনের কৌশল।
এরপর শুরু হবে প্রতারণার নানা কৌশল। বিনিয়োগ করতে বলা হবে ১০ হাজার টাকা। ওই টাকার বিনিময়ে ফেরত দেওয়া হবে ১৪/১৫ হাজার টাকা। এভাবেই আস্তে আস্তে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় অনলাইন ভিত্তিক প্রতারক চক্র।
বিনিয়োগে প্রলুব্ধ
পরের ধাপ—বিনিয়োগ। ১০ হাজার টাকা দিলে ১৪–১৫ হাজার ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব। প্রথম লেনদেনেই প্রতিশ্রুত লভ্যাংশ ফেরত আসে। সোহেল রানার সন্দেহ দূর হয়, আস্থা জন্মায়। এরপর শুরু হয় বড় বিনিয়োগের খেলা—২০ হাজার, ৮০ হাজার, তারপর কয়েক লাখ টাকা।
বাদী পক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবেদিন পতাকানিউজকে বলেন, ‘প্রথম কাজে ৬৭৫ টাকা বিকাশে দিয়ে বিশ্বস্থতা অর্জন করেন বাদীর। এরপর বাদীকে বলেন বিনিয়োগ করতে। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের নড়াইল শাখার গ্রাহক নাহিদ হোসেন মোল্লার (২৮৩১৫৮০০০২০০১, রাউটিং নম্বর- ০৯০৬৫০৬৪৪) অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগের ১০ হাজার টাকা জমা করতে বলেন। এ টাকার বিপরীতে বাদীর অ্যাকাউন্টে লভ্যাংশসহ ১৫ হাজার ১শ’ টাকা ফেরত দেন বাদীকে।
একই কায়দায় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সিটি ব্যাংকের পাবনা সদর শাখার গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে (১৫০৪১৭৬৯৪৫০০১, রাউটিং নম্বর-২২৫৭৬১৭৮২) ফের ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করান। এর বিপরীতে অনলাইন অ্যাপে ১২ হাজার ৪০৮ টাকা মাইনাস ফিগার দেখান। এ টাকা জমা করলে আগের ১০ হাজার টাকাসহ লভ্যাংশ দেওয়া হবে বলে জানান। পরে বাদী ফের ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের রফিকুল ইসলামের নামে অপর একটি অ্যাকাউন্টে ১২ হাজার ৪০৮ টাকা বিনিয়োগ করেন। এর বিনিময়ে বাদীকে ২৫ হাজার ৭৯১ টাকা ফিরিয়ে দেন।
এভাবে প্রতারক চক্র বড় বিনিয়োগে বেশি লাভের কথা বলেন। এসময় ১ লাখ টাকা বিনিয়েঅগ করলে ৭০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে জানান। বাদীও প্রতারক চক্রের কথায় প্ররোচিত হয়ে বিনিয়োগ করেন। এতে পূবালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের টানবাজার শাখার জাহিদ হাসানের অ্যাকাউন্টে (০৭২০৯০১০৩২৭৮৩, রাউটিং নম্বর-১৭৫৬৭১৭৫১) ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। এছাড়া বাকি ২০ হাজার টাকা বিকাশ নম্বরে (০১৮৮৬-৯৭৪৫১৭) পাঠান। এ টাকা বিনিয়োগের পর অনলাইন অ্যাপসে ফের ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬শ’ টাকা মাইনাস ফিগার দেখায়। তবে মাইনাস ফিগারের ওই টাকা বিনিয়োগ করলে পুরো টাকার সঙ্গে লভ্যাংশসহ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় প্রতারক চক্র। পরে বাদী ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬শ’ টাকা ৫টি নাম্বারে বিকাশে পাঠান।
এতেও অনলাই অ্যাপসে ৩ লাখ ৩০ হাজার ২৪০ টাকা মাইনাস ফিগার দেখায়। এবার প্রতারক চক্র জানান, ওই টাকা জমা করলে লভ্যাংশসহ ফেরত দেওয়া হবে। এবার বাদী ফের বিকাশে আরো ১২টি নাম্বারে ৩ লাখ ৩০ হাজার ২৪০ টাকা পাঠান। এরপর প্রতারক চক্র জানান, ৬০টি অনলাইন কাজ দেওয়া হবে। এ কাজ করে দিলে টাকাগুলো বোনাসসহ ফেরত পাওয়া যাবে।
এবার নতুন ফাঁদ
এবার নতুন ফাঁদে ফেলা হলো বাদীকে। তিনি ৩ গুণ বোনাস পেয়েছেন জানিয়ে তাকে ফের ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬ টাকা মাইনাস ফিগার দেখায়। এ টাকা জমা করলেই তিনি সমস্ত টাকা ফেরত পাবে বলে জানান। তবে ওই পরিমাণ টাকা বাদীর কাছে নেই জানালে প্রতারক চক্র জানান, এ টাকার ৭০ শতাংশ ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৬ টাকা বিনিয়োগ করলে পুরো টাকা ফেরত পাবেন।
গত ১১ মার্চ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে এবার সিটি ব্যাংকের চট্টগ্রামের কালুরঘাট শাখার আব্দুল খালেকের অ্যাকাউন্টে (২৩০৪৪০৫৩৪২০০১) টাকা পাঠান। এ টাকা জমা করার পর ফের ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা মাইনাস ফিগার দেখায়। এবার প্রতারক চক্র বলেন, ওই টাকা জমা করলে পুরো টাকা ফেরত পবেন বাদী। ফের নতুন ফাঁদে পড়েন বাদী। এবার বাদীর কাছে আর টাকা নেই জানালে প্রতারক চক্র জানান, এটি তাদের নিয়ম।
ফাঁদে পড়ে আগের পুরো টাকা উদ্ধারের জন্য প্রাণপন চেষ্টায় রয়েছেন মামলার বাদী। এবার তাকে জানানো হয়, ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে। এ টাকা বিনিয়োগ করলে পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যাবে বলেও নিশ্চয়তা দেন। বাদীও পূর্ববর্তী টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আবারও তাদের ফাঁদে পা দেন। গত ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ঢাকার গুলশান শাখার তানভীর ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে (০৬৫৩৪০০৪৩৫৮) ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা করেন। এ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৬ টাকা ফেরত পাওয়ার আবেদন করেন। এবার প্রতারক চক্র আরেকটি নতুন ফাঁদ পাতেন।
বাদীর লভ্যাংশসহ ১৯ লাখ ৩০ হাজার ১৫৫ টাকা অনলাইন অ্যাপসে জমা হয়েছে। টাকা পেতে হলে ওই টাকার ৫০ শাতাংশ সিকিউরিটি ফি জমা দিতে হবে বলে জানায়। অন্যথায় এ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না বলে জানায় প্রতারক চক্র। এক্ষেত্রে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭ হাজার টাকা সিকিউরিটি ফি জমা করতে হবে বলে জানানো হয়। তবে বাদী পূর্বের বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত না পেয়ে নতুন আর কোন বিনিয়োগ করেননি। এ বিষেয়ে মামলা দায়ের করেন আদালতে।
একই প্রতারণার ফাঁদ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় পতাকানিউজ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তাদের মধ্যে এক নারী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘টেলিগ্রামে অপরিচিত এক আইডি থেকে যোগাযোগ করে কয়েকটি পণ্যের রিভিউ করিয়ে ২ হাজার টাকা বিকাশে পেমেন্ট করেছিল। পরে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগের কথা বললে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই।’
পতাকানিউজ/আরএস/কেএস

