ব্যবসায়ীদের আপত্তি উপক্ষো করেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ডলারে ট্যারিফ আদায় শুরু হয়েছে। সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ট্যারিফ কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে রবিবার রাতে এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ট্যারিফ বৃদ্ধির হার গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ।
ট্যারিফ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই বন্দর ব্যবহারকারীরা এর বিরোধীতা করছিলেন। ব্যবসায়ীদের বিরোধীতার মুখেই প্রায় ৪০ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ বাড়ানো হল। সবশেষ ১৯৮৬ সালে ট্যারিফ বাড়ানো হয়।
এর আগে ২৪ জুলাই বন্দরের প্রস্তাবিত ট্যারিফ অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তারপর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে এক দফা আলোচনাও হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানো।
ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের বেশ কয়েকটি টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের আলোচনা চলছে। এই মুহূর্তে ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এলো। এতে চূড়ান্ত হিসেবে লাভবান হবে বিদেশি অপারেটররাই। আর বন্দর ব্যবহারকারীদের দাবি, একসঙ্গে এত বেশি ট্যারিফ বাড়ানোর চাপ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়বে সাধারণ ভোক্তার ওপর। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পখাত আরো বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতের কাঁচামাল আমদানির সময় একবার ট্যারিফ দিতে হবে। আবার রপ্তানির সময় ট্যারিফ দিতে হবে। ফলে এই খাতের আমদানি ও রপ্তানিতে ২বার ট্যারিফ বাড়বে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি ছিল আমাদের। আমরা সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব করি। কিন্তু এখন ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ল। এই বাড়তি ট্যারিফের জন্য শুরুতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা চাপে পড়বে। আর সবশেষে ভোগান্তি হবে সাধারণ ভোক্তাদের।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ল। এরপরও তা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক কম।
ডলার দরে ট্যারিফ আদায় : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন থেকে যে ট্যারিফ আদায় করবে তা হবে ডলারের হিসেবে। নতুন প্রস্তাবে ১ ডলারের দর ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। পরে ডলারের দাম বাড়লে বাড়বে ট্যারিফও।
আগে একটি ২০ ফুট একটি কন্টেইনারের জন্য ট্যারিফ ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। ট্যারিফের নতুন হার অনুসারে, আমদানি কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ট্যারিফ বাড়বে ৫ হাজার ৭২০ টাকা আর রপ্তানি কনটেইনার হলে বাড়বে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। অর্থাৎ কন্টেইনার প্রতি ট্যারিফ বাড়ল গড়ে ৩৭ শতাংশ।
কন্টেইনার জাহাজের সেবা নেয়ার জন্য আলাদা ট্যারিফ দিতে হয় বন্দরে। জাহাজ থেকে প্রতি একক কন্টেইনার ওঠানো ও নামানো জন্য ট্যারিফ দিতে হবে ৬৮ ডলার। আগে ট্যারিফ ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। এখন তা বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে। টাকার হিসেবে যা প্রায় তিন হাজার টাকা বাড়তি।
কন্টেইনার ছাড়া অন্য সব ধরনের পণ্যে কেজিপ্রতি ট্যারিফ আগে ছিল প্রতি কেজি ৩৫ পয়সা। নতুন হারে যা বেড়ে হয়েছে কেজি প্রতি গড়ে ৪৯ পয়সা। শতকরা হিসেবে গড় ট্যারিফ বৃদ্ধি ৪১ শতাংশ।
ট্যারিফ বলতে কি বোঝায়?
ট্যারিফ (Tariff) হলো এক প্রকার কর বা শুল্ক যা একটি দেশের সরকার অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য বা পরিষেবার ওপর আরোপ করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করা, দেশীয় বাজারে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার উৎসাহিত করা এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা।
ট্যারিফ কিভাবে কাজ করে
পণ্যকে দামি করা: ট্যারিফ আরোপিত হওয়ার কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্য দেশীয় পণ্যের তুলনায় কম আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা: বিদেশি পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা দেশীয় পণ্য কিনতে উৎসাহিত হয়, যা স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসার বিকাশে সহায়তা করে।
রাজস্ব বৃদ্ধি: সরকার আমদানি শুল্ক থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করে, যা জাতীয় কোষাগারে জমা হয়।
বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ: ট্যারিফ একটি বাণিজ্য নীতি যা বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ও গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ব্যবহার করে।
ট্যারিফের প্রকারভেদ
ট্যারিফ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: আমদানি শুল্ক (Import Tariff): অন্য দেশ থেকে আসা পণ্যের ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হয়। রপ্তানি শুল্ক (Export Tariff): কোনো দেশ থেকে যখন কোনো পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করা হয়, তখন এর ওপর এই শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে।
সংক্ষেপে, ট্যারিফ একটি দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন ও সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য একটি কৌশল।
পতাকানিউজ/এসজিএন

