ডিমের পরিত্যক্ত খোসা থেকে পাউডার তৈরি করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন বেলাল মোল্লা নামের জয়পুরহাটের এক উদ্যোক্তা। এ পাউডার ব্যবহার হচ্ছে মাছ, মুরগি ও গবাদি পশুর খাবারের ক্যালসিয়াম এবং জমির মূল্যবান খনিজ পদার্থ হিসেবে।
জেলার বিভিন্ন পোল্ট্রি হ্যাচারি থেকে ডিমের খোসা সংগ্রহ করে তৈরি করা হচ্ছে পাউডার। বর্তমানে যা বিক্রি হচ্ছে জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এতে ভাগ্য বদলেছে উদ্যোক্তা বেলাল মোল্লার। আর এ পাউডার নিয়ে নানা সম্ভাবনার কথা বলছেন জেলার কৃষি ও পোল্ট্রি সেক্টরের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জয়পুরহাট সদর উপজেলার বেলতলী গ্রামের বেলাল মোল্লা ২০১৭ সাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকার পোল্ট্রি ও হ্যাচারি মালিকদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত ডিমের খোসা সংগ্রহ করে বগুড়ায় জৈব সার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন। বিনিময়ে আবর্জনা অপসারণে বেলাল মোল্লাকে পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা দিতেন হ্যাচারি মালিকরা। পাশাপাশি তিনি লিটারের ব্যবসা করতেন। পোল্ট্রি কারখানা থেকে লিটার কিনে তিনি বিক্রি করতেন।

একসময় তার কৌতূহল জাগে ডিমের খোসা দিয়ে বগুড়ার ব্যবসায়ীরা কি করেন তা জানার। পরে তিনি জানতে পারেন ডিমের খোসা জৈব সার হিসেবে বিক্রি করেন বগুড়ার ব্যবসায়ীরা। ডিমের খোসার পাউডার যে মাটি উর্বরের পাশাপাশি মাছ, পোল্ট্রি ও পশুর খাবারে ক্যালসিয়ামের যোগান দেয় সেটা জানার পর ডিমের খোসার পাউডার তৈরির কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন বেলাল। টাকা না থাকায় তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশন।
জাকস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পিকেএসএফ এর অর্থায়নে ২০২৪ সালে বেলাল জয়পুরহাট সদর উপজেলার বেলতলী এলাকায় তার নিজস্ব জায়গায় স্থাপন করেন ডিমের খোসা থেকে পাউডার তৈরির কারখানা। যেখানে প্রতিদিন ডিমের খোসার পাউডার তৈরি করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছেন বেলাল। আর এ পাউডার ব্যবহারে অত্যন্ত কম খরচ ও সহজ লভ্যতায় মাটির খনিজ পদার্থের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কাজে লাগছে জৈব সারের মূল্যবান উপাদান হিসেবে। বেলালের এ উদ্যোগ মৎস্য এবং পোল্ট্রি খাতে যোগান দিচ্ছে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের। উপকার পেয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিমের পাউডার নিতে আসছেন কৃষক, মৎসচাষী ও পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা।
বিনামূল্যে ডিমের খোসা এনে পরিষ্কার করে নিজের মেশিনে চূর্ণ করে ৫০ কেজির পাউডার বেলাল বিক্রি করছেন ৭৫০ টাকায়। তার এ কারখানায় সহযোগিতার জন্য তিনি নিয়োগ করেছেন ৫ জন শ্রমিক। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য খরচের পরও মাসে ডিমের পাউডার বিক্রি করে বেলালের এখন আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতে সহজলভ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব দূর হওয়ায় দিন দিন চাহিদা বাড়ছে ডিমের পাউডারের।
উদ্যোক্তা বেলাল মোল্লা বলেন, ‘আগে লিটারের ব্যবসা করতাম। পাশাপাশি বিভিন্ন হ্যাচারি ও পোল্ট্রি থেকে ডিমের খোসা সংগ্রহ করে বগুড়ায় জৈবসার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতাম। ডিমের খোসা টাকা দিয়ে কিনতে হয়নি। বরং হ্যাচারি থেকে খোসা অপসারণের জন্য হ্যাচারি মালিকরা টাকা দিতেন। পরে দেখি বগুড়ার ব্যবসায়ীরা সেই ডিমের খোসা ভেঙে জৈবসারের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি করতেন। তখন নিজেই ডিমের খোসা চূর্ণ করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। ২০২৪ সালে বেলতলীতে নিজস্ব জায়গায় পাউডার তৈরির কারখানা স্থাপন করি। যেখানে আমার সঙ্গে কাজ করে ৫ জন কর্মচারীও। প্রতিদিন যে পাউডার তৈরি হয় তা অর্ডারের ভিত্তিতে সরবরাহ করছি। জয়পুরহাটে এ প্রথম কারখানা হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা পাউডারের। বর্তমান জয়পুরহাটসহ আরও ১৫টি জেলায় পাউডার সরবরাহ করছি। চাহিদা মতো সরবরাহ দিতে পারছি না।’
কারখানার শ্রমিক আব্দুল খালেক বলেন, ‘ডিমের খোসা পরিষ্কার করে মেশিনের ভেতর দেওয়ার পর তা পাউডার হয়ে বের হয়ে আসে। তারপর এখান থেকে বাজারজাত করা হয়। এখান থেকে যে বেতন পাই তা দিয়ে শুধু আমি নয় আমার মত আরও ৫ জন শ্রমিকের সংসার চলছে ভাল মতো।’
সদর উপজেলার জামালগঞ্জ এলাকার হাবিব হাসান বলেন, ‘এতদিন জানতাম ডিমের খোসা অপ্রয়োজনীয় জিনিস। কখনও ভাবিনি এটা কোনো কাজে লাগতে পারে। এখন দেখছি এখান থেকে যে পাউডার তৈরি হচ্ছে তা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কেউ জমির জন্যও কিনে নিয়ে যাচ্ছে ‘
ক্ষেতলাল উপজেলার বেলগাড়ি গ্রামের মাছ চাষী আব্দুল আলিম বলেন,‘মাছের বৃদ্ধি হয় ডিমের খোসার পাউডার খাদ্যের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে। জেলা মৎস্য অফিস থেকে এমন পরামর্শ পেয়ে আমি পুকুরে নিয়মিত ডিমের খোসার পাউডার মিশ্রিত খাদ্য পুকুরে সরবরাহ করে ভালো ফল পেয়েছি।’
জয়পুরহাট সদর উপজেলা কৃষি অফিসার রাফসিয়া জাহান বলেন, ‘মাটিতে দিন দিন ইনটেনসিভ চাষাবাদে কৃষকরা সারকেই খনিজ পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করছে। কৃষকরা জমির ফসল উৎপাদনে বিশেষ করে মাইক্রোনিউটেন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সালফার তুলনামূলক কম ব্যবহার করে। যদি তারা ডিমের খোসা যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে চূর্ণ করে কৃষি কাজে ব্যবহার করেন তাহলে ওইসব খনিজ পদার্থের অভাব অল্প খরচে খুব সহজে মেটানো সম্ভব। এতে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বাড়বে, অন্যদিকে চাষাবাদে লাভও বেশি হবে।’
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার মহির উদ্দিন বলেন, ‘জয়পুরহাট দেশের অন্যতম পোল্ট্রি জোন হিসেবে সমধিক পরিচিতি জেলা। এ জেলায় ৬৩টি হ্যাচারি আছে। এ হ্যাচারি থেকে এক দেড় মাসে বাচ্চা ফোটানো হয়। বাচ্চা ফোটানোর পর যে খোসাগুলো থাকে, সেগুলো সাধারণত ওয়েস্ট প্রোডাক্ট হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু এটা খুবই মূল্যবান। ডিমের খোসা থেকে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ গবাদিপশুর যে খাদ্যের প্রয়োজন হয় সেটা তৈরি করা যায়। অনেক সময় দেশি মুরগির ডিমের খোসা পাতলা হয়। সেই ক্ষেত্রে ডিমের খোসা যদি ওই মুরগিকে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় তাহলে দুই থেকে তিন দিন পরেই দেখা যাবে ডিমের খোসা শক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ডিমের খোসা তৈরির জন্য যে খাদ্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়, সেই ক্যালসিয়ামের সোর্স হিসেবে পশু ও মুরগির খাদ্যে ডিমের খোসা ব্যবহার হতে পারে। ডিমের খোসা খুবই মূল্যবান উপাদান।’
পতাকানিউজ/এসি/এমওয়াই

