আসছে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিএনপি এখন ভোটমুখী রাজনীতির রূপরেখা ঠিক করছে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর দলটির এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে—কীভাবে জনগণকে নির্বাচনের দিকে টেনে আনা যায় এবং নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের ঘোষিত কর্মসূচি এবং চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিএনপির স্থায়ী কমিটি এ কৌশল নির্ধারণ করেছে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি এখন শুধু রাজপথ নয়, মানুষের ঘরেও যাবে—‘ডোর টু ডোর’ কর্মসূচির মাধ্যমে।
দলটি মনে করছে, জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত না করলে নির্বাচনী ঢেউ তোলা সম্ভব নয়। এ কাজে নারী নেতাকর্মীদেরও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা হবে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাগপাসহ কয়েকটি দল সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি ও জুলাই সনদের দাবিতে তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করছে। বিএনপির বৈঠকে এ বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। দলটির বিশ্লেষণ—এই কর্মসূচি রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল, যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি আদায়ের জন্য। বিএনপি মনে করছে, রাজনৈতিক ময়দানে এসব কর্মসূচির জবাবও দিতে হবে রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমেই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এই আন্দোলন কার বিরুদ্ধে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। তাঁর প্রশ্ন—এটা কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে, নাকি বিএনপির বিরুদ্ধেই কোনো ফাঁদ? তবে যে দলই কর্মসূচি দিক, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে জবাব দেবে।
অন্য সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মন্তব্য করেন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া রাজপথে কর্মসূচি দিলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়। তাঁর মতে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দেরি যত হবে, দেশ তত সংকটে পড়বে। তিনি সতর্ক করেন, দ্রুত নির্বাচন না হলে বিভক্তি ও সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একটি ইসলামী দল পিআর ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করছে, যা সুপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান। তাঁর ভাষায়, ‘পরাজিত শক্তির সঙ্গে আঁতাত রাজনীতির জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে।’
বিএনপি আগামী নির্বাচনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইশতেহার তৈরি করছে। জানা গেছে, ৩১ দফা সংস্কার-প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এই ইশতেহার প্রণয়ন করা হবে। প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। তবে কেন্দ্র থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—সম্ভাব্য প্রার্থীরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার চালান এবং কোনোভাবেই গ্রুপিং বা দ্বন্দ্বে না জড়ান।
দলটি নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণকে বোঝাবে কেন ফেব্রুয়ারিতেই ভোট প্রয়োজন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ বিলম্বিত হলে জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম বিফল হবে। একই সঙ্গে ৩১ দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে, যা বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল। বৈঠকে জানানো হয়, এসব ঘটনায় সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে দলের ভেতর শৃঙ্খলা ফিরেছে বলে বিএনপি মনে করছে। দলটির নেতৃত্ব এখন জনগণের কাছে ‘গুণগত পরিবর্তন’ আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
বৈঠকে জুলাই সনদ প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটিকে জানানো হয়—সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন সংস্কার প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের আগেই অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা উচিত। আর সাংবিধানিক সংস্কার নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদ করবে।
আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে বিএনপি এখন সর্বাত্মক প্রস্তুতির পথে। রাজপথ থেকে ঘরে ঘরে—সবখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে নির্বাচনী মাঠে একক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে দলটি।
পতাকানিউজ/এনটি

