দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে যেন স্বচ্ছ কাচের এক প্রাসাদ। কিন্তু কাছে গেলেই পুরাপুরি পাল্টে যাবে সেই ধারণা। এটি কাচ কিংবা ইটের নয়, পরিত্যক্ত রঙ-বেরঙের প্লাস্টিকের বোতলে গড়া আশ্চর্য এক দোতলা বাড়ি। স্থানীয়দের মুখে যার নাম ‘বোতল বাড়ি’। ডুপ্লেক্স এ ভবনটি দেখতে ঠিক প্রাসাদের মতো। অজোপাড়া গ্রামের বাড়িটি এখন পুরো জেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রামানন্দেরপাড় গ্রামে ঢুকতেই দূর থেকে চোখে পড়বে এ রঙিন বাড়ির। পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট দোতলা ‘বোতল বাড়ি’ দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের আসছেন মানুষ। ছবি তুলে পোস্ট করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
গল্পের শুরুটা ছিল অনেকটা কৌতূহল আর সংশয়ের। অনেকের কাছেই বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস আর ঠাট্টার। দন্ত চিকিৎসক পলাশ চন্দ্র বাড়ৈ যখন গ্রামবাসীকে বললেন, তিনি পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি তুলবেন, তখন অনেকেই তার কথা হেসে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এক সকালে ট্রাকভর্তি পরিত্যক্ত বোতল পলাশের বাড়ির আঙিনায় নামতে শুরু করল। শ্রমিকরা বোতলে বালু ভরছে, সারি সারি সাজাচ্ছে। তখনও কেউ বিষয়টি বুঝতে পারেনি, এখানে তৈরি হতে চলেছে এক পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের বিস্ময়।
দিন যেতে যেতে কাঠামো দাঁড়াতে শুরু করল, দেয়ালে ফুটে উঠল রঙের খেলা। যারা একসময় বলেছিল, ‘আবর্জনা দিয়ে বাড়ি হবে না’, তাদের মুখেই শোনা যাচ্ছে,‘এ তো রাজপ্রাসাদ!’।
পলাশের দাবি, জাপান থেকে এ প্রযুক্তি এসেছে। ভিডিও দেখে তিনি পরিকল্পনা করেছেন। দেয়াল থাকবে গরমে ঠান্ডা, শীতে গরম। ইটের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি শক্ত, আর নির্মাণ খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ কম। সবচেয়ে বড় সাফল্য-অযত্নে ফেলে দেওয়া হাজার হাজার বোতল এখন বাঁচিয়েছে পরিবেশ, আর দিয়েছে মানুষের টেকসই আশ্রয়।
বাড়ি তৈরির ভাবনা চিকিৎসকের মাথা থেকে বের হলেও কাজটি করেছেন গ্রামের রাজমিস্ত্রি কমল চন্দ্র। তিনি জীবনে এ প্রথম বোতল দিয়ে বাড়ি তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স ভবন। ভবনের দেয়ালে ইটের ব্যবহার করা হয়নি। শুধু বালু দিয়ে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়েছে। সেই বালুভর্তি বোতল একটার গা ঘেঁষে আরেকটি রেখে বালু আর সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এভাবেই প্রতিটি দেয়াল তৈরি করা হয়েছে।
শুধু দেয়াল নয়, পুকুরের ঘাট, ভবনের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে গভীর নলকূপের আশপাশটাও এ বোতলে তৈরি।
রাজমিস্ত্রিরা বলছেন, জীবনে এমন নির্মাণ কাজ তারা দেখেননি। এমন নির্মাণ পদ্ধতি তাদের জীবনের বড় শিক্ষা। যে ভবন তৈরিতে ইট ব্যবহার করা হয়নি। তাদের হিসেবেই কম করে হলেও ২০ শতাংশ নির্মাণ সামগ্রী কম লেগেছে।
পলাশের বাবা যতিশ চন্দ্র বাড়ৈ-মা কমলা বাড়ৈ গর্বে বুক ভরে আছেন, আর গ্রামবাসীর কাছে এই বাড়ি এখন ‘পরিবেশের তাজমহল’।

রাজিহার সকারী প্রাথমি বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যতিশ চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, বোতল বাড়ি যেন প্রমাণ করে দিয়েছে-দূষণ সৃষ্টিকারী আবর্জনাও, সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় হয়ে উঠতে পারে স্বপ্নের প্রাসাদ। শুরুতেই যারা বাড়ি নির্মাণ নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন, এখন তাদের পরিবারের অতিথিরাও এ ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখতে আসেন।
পরিবেশবান্ধব আর কম খরচে টেকসই নির্মাণ হলেও প্রশ্ন উঠছে, এই ঘর কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ফেলে দেওয়া বোতল পুনর্ব্যবহার পরিবেশের জন্য ভাল। তবে যদি বোতল আগে রাসায়নিক বহন করে থাকে, তা ভালোভাবে ধোয়া না হলে বিষাক্ত কণা বাতাসে মিশতে পারে। গরমে বোতলের ভেতরের প্লাস্টিক গলে বা গন্ধ ছড়িয়ে শ্বাসতন্ত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া, বোতলের ফাঁপা অংশে পানি জমে মশা বা অন্যান্য পোকা জন্মাতে পারে। তবে এসব ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব, যদি বোতল সংগ্রহ ও প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হয়।
পতাকানিউজ/আরআই/আরবি

