নিঃসন্দেহে রসুন রান্নার একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যা খাবারে এক অনন্য গন্ধ ও স্বাদ যোগ করে। কিন্তু শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ানোই নয়, রসুন নানাভাবে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করে। তাই রান্নার পাশাপাশি কাঁচা রসুন খাওয়াকে অনেকে ‘সুপারফুড’ বলে থাকেন।
রসুনের সকল স্বাস্থ্য উপকারিতার পেছনে রয়েছে এর প্রধান সক্রিয় যৌগ অ্যালিসিন (Allicin)। এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। একটি মজার বিষয় হল, পুরো রসুনের কোয়ায় অ্যালিসিন থাকে না। এটি তৈরি হয় যখন রসুন কুচি করা, থেতলে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় ‘অ্যালিনেজ’ নামক এনজাইম সক্রিয় হয়ে অ্যালিনকে অ্যালিসিনে রূপান্তরিত করে। এই অ্যালিসিনই রসুনের ঔষধি গুণের প্রধান উৎস। তবে অ্যালিসিন খুবই স্থায়ী এবং তাপে সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য উপকার পেতে রসুন কুচি করে বা পিষে কমপক্ষে ১০ মিনিট রেখে তারপর খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়, যাতে অ্যালিসিন তৈরি হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়।
প্রতিদিন কাঁচা রসুন খাওয়ার ৭টি প্রধান উপকারিতা
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সর্দি-জ্বর দূরে রাখে
রসুন ভিটামিন সি, বি৬, ম্যাঙ্গানিজ এবং সেলেনিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিতে ভরপুর, যা আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের (NLM) এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রসুন খান তাদের সর্দি-কাশি, জ্বর এবং অন্যান্য সাধারণ সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে।
গবেষণাটি জানায়, রসুন একটি প্রাকৃতিক ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ যা শরীরকে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। শীতের মৌসুমে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকলে প্রতিদিন সকালে এক কোয়া কাঁচা রসুন আপনার শরীরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরকে মজবুত করতে পারে।
২. রক্তচাপ কমায় ও হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে
উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়, যা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো অসুস্থতার কারণ। রসুনের অ্যালিসিন এবং অন্যান্য সক্রিয় যৌগ রক্তনালীকে প্রসারিত ও শিথিল করতে সাহায্য করে, যা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং রক্তচাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখেছেন, নিয়মিত রসুন খেলে সিস্টলিক এবং ডাযাস্টোলিক উভয় ধরনের রক্তচাপই উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এটি একটি সহজলভ্য ও প্রাকৃতিক থেরাপি হতে পারে। তবে এটি ওষুধের বিকল্প নয়, বরং থেরাপি হিসেবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
৩. কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেড়ে গেলে তা ধমনীতে জমে গিয়ে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, নিয়মিত রসুন খাওয়া, মানুষের শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এটি ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) মাত্রা বাড়ায়।
৪. একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক
রসুনে শক্তিশালী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকে পরিণত করেছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং রোগের তীব্রতা কমাতে রসুনের জুড়ি মেলা ভার।
৫. শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং খাদ্যাভাসের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ , যেমন ভারী ধাতু (সীসা, পারদ ইত্যাদি) জমা হয়। রসুনে থাকা সালফার যৌগ লিভারের এনজাইমকে সক্রিয় করে, যা শরীর থেকে এই বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি কার ব্যাটারি ফ্যাক্টরির কর্মীদের যাদের রক্তে সীসার মাত্রা বেশি ছিল, তাদেরকে রসুন সেবন করানো হয়। কয়েক সপ্তাহ পর দেখা গেল , তাদের রক্তে সীসার মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এছাড়াও রসুন শরীরে গ্লুটাথাইয়ন (Glutathione) নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎপাদনও বাড়ায়, যা লিভারকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
৬. প্রদাহ কমায় ও বয়স ধরে রাখে
রসুন মানুষের শরীরের ভেতর থেকেই রোগ প্রতিরোধ করে সুস্থ ও সতেজ থাকতে কাজ করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়ার কারণে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার গতি কমিয়ে দেয়। তাছাড়া দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
৭. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রসুন খাওয়া রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমায়, বরং এটি মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে স্মৃতি, চিন্তা করার ক্ষমতার উন্নতি ঘটায় এবং আল ঝাইমার ও ডিমেনশিয়া রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
কাঁচা রসুন খাওয়ার নিয়ম
উপকারিতা পেতে শুধু রসুন খেলেই হবে না, সঠিক পদ্ধতিতে খেতে হবে:
সকালে খালি পেটে রসুন খাওয়ার উপকারিতা
সেরা সময়: সকালে খালি পেটে খাওয়া, কারণ আপনার শরীর এটি থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারে। এটি করতে না পারেন, তাহলে দিনের যেকোনো সময় খেতে পারেন, খাবারের আগে বা পরে।
প্রস্তুতির পদ্ধতি: একটি কোয়া রসুন খোসা ছাড়ান। কুচি করে বা থেতলে নিন এবং কমপক্ষে ১০ মিনিট রেখে দিন। এই সময়ে অ্যালিসিন তৈরি হবে। তারপর এটি খান।
খাওয়ার উপায়: কাঁচা রসুনের তীব্র গন্ধ ও স্বাদ অনেকেরই অপছন্দ। এটি এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন, অথবা কুচি করে সালাদ বা দইয়ের সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন।
ধীরে ধীরে শুরু করুন: একবারে অনেকটা খেয়ে ফেলবেন না। প্রথমে অর্ধেক কোয়া বা একটি ছোট কোয়া দিয়ে শুরু করুন, তারপর ধীরে ধীরে বাড়ান যাতে শরীর অভ্যস্ত হয়।
সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
রসুনের উপকারিতা অনেক, কিন্তু বেশি পরিমাণে (বিশেষ করে কাঁচা) খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে:
পেটের সমস্যা: বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস, বদহজম, বমি বমি ভাব হতে পারে।
অ্যালার্জি: কারো কারো রসুনে অ্যালার্জি থাকতে পারে।
রক্ত পাতলা: রসুন প্রাকৃতিকভাবে রক্ত পাতলা করার কাজ করে। যারা রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন: Aspirin, Warfarin) খান, তাদের জন্য এটি ঝুঁকি হতে পারে, কারণ এটি রক্তপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১-২ কোয়া রসুন খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। যারা ওষুধ খান বা অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছেন, অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকলে, নিম্ন রক্তচাপ থাকলে, গ্যাসের সমস্যা বা অ্যাজমা থাকলে, রসুনে অ্যালার্জি থাকলে, গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যপান করানোর সময় তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রসুন খাওয়া উচিত।
প্রতিদিন মাত্র এক কোয়া কাঁচা রসুন আপনার স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিনিয়োগ। এটি আপনার শরীরকে শক্তিশালী, হৃদযন্ত্রকে রক্ষা করে, শরীর থেকে খারাপ পদার্থ বের করে দেয় এবং মস্তিষ্ককে সচল রাখে। তবে সঠিক পদ্ধতি মেনে এবং সতর্কতার সাথে এটি খাওয়া জরুরি।
সূত্র-
National Library of Medicine (যুক্তরাষ্ট্র) – গবেষণা পত্র
Journal of Nutrition – গবেষণা পত্র
India TV Health
পতাকানিউজ/এসজিএন

