বন্ধুত্ব এমন এক ব্যাপার, যা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বন্ধু একজন ব্যক্তি বা মিত্র যার সাথে পারস্পরিক ভালোবাসা, স্নেহ, এবং আনুগত্যের সম্পর্ক থাকে এবং যিনি সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন। বন্ধু হলো এমন একজন, যার কাছে মন খুলে কথা বলা যায় এবং যার সাথে মনের সব কথা ভাগ করে নেওয়া যায়। বন্ধুত্ব মানে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সমর্থন এবং একে অপরের ভালোমন্দে পাশে থাকা।
কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে, যা বন্ধুত্বকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। ঘোস্টিং থেকে শুরু করে অতিরিক্ত ভেন্টিং, কোন অভ্যাসগুলো নিঃশব্দে বন্ধুত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে? প্রশ্নটা খুব সহজ মনে হলেও উত্তরটা জটিল: কীভাবে প্রাপ্তবয়সে বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?
কাজের চাপ, সংসারের দায়িত্ব, বাজার-সদাই, বিল পরিশোধ আর একটুখানি ঘুমের লড়াইয়ের মাঝেই আমরা টিকে থাকার চেষ্টা করি। এমন ব্যস্ত জীবনে বন্ধুর পাশে থাকা— এবং একই সঙ্গে নিজের পাশে দাঁড়ানো— দুইটাই অনেক সময় অসম্ভব মনে হয়।

সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপারটা হলো, শৈশব কিংবা কৈশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বগুলো কালের স্রোতে একসময় হারিয়ে যায়। প্রাপ্তবয়সে এসে নতুন করে যেটুকু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সেটাও টিকিয়ে রাখাটা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিদিনই মনে হয় যেন জীবনের ঝড়ে ভেসে যাচ্ছি। কিছু বন্ধুত্ব ঢেউয়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। আবার অনেক সময়, না জেনেই, আমাদেরই কিছু আচরণ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বকে দূরে ঠেলে দেয়।
বন্ধুত্বের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। তবুও মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ থেকে পাওয়া কিছু অভিজ্ঞতা বলছে— কিছু অভ্যাস নিঃশব্দে আমাদের সম্পর্কগুলোকে ক্ষয় করে দেয়।
এখানে থাকছে সেই সাতটি অভ্যাস, যেগুলো আপনার অজান্তেই বন্ধুত্বের বন্ধনকে দুর্বল করছে— এবং বাঁচানোর উপায়ও।
১. সিরিয়াল ঘোস্টিং
বন্ধুত্বে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনো খবর না দিয়ে আবার হঠাৎ ‘কেমন আছো?’ বলে ফিরে আসা— এমন আচরণ নতুন বন্ধুর জন্য ভীষণ বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
নিশ্চয়ই জীবন ব্যস্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু যখন একজন মানুষ বারবার আপনার জন্য অপেক্ষা করে আর মনে হয় যে সম্পর্কটা একপাক্ষিক, তখন ক্ষোভ জমতে থাকে। ঘোস্টিং অনেক সময় আমাদের কাছে সহজ সমাধান মনে হয়— বিশেষ করে যখন কোনো অস্বস্তিকর আলাপ এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু এর ফল ধীরে ধীরে বিশ্বাসকে ক্ষয় করে। আর বন্ধুত্বের জন্য বিশ্বাস হলো অক্সিজেনের মতো অপরিহার্য।
তাই যদি কোনো কারণে আপনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন বা কিছু সময়ের জন্য সরে থাকতে চান, অন্তত বন্ধুকে একটা ছোট্ট বার্তা দিন— জানিয়ে রাখুন যে কিছুদিন পাশে থাকতে পারবেন না। এই সামান্য সততাই বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
২. অবিরাম ভেন্টিং
বন্ধুত্ব মানে অবশ্যই শেয়ার করা— আনন্দ, দুঃখ, ভয়, আশা সবই। কিন্তু যখন প্রতিটি আলাপই পরিণত হয় একের পর এক জীবনের সংকট নিয়ে দীর্ঘ অভিযোগে, তখন সেটা ধীরে ধীরে কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।
অতিরিক্ত ভেন্টিং বন্ধুকে অজান্তেই এক ধরনের অবৈতনিক থেরাপিস্টে পরিণত করে ফেলে। শুরুতে হয়তো তারা সহমর্মিতা দেখায়, কিন্তু একসময় এই চাপই তাদের ক্লান্ত করে তোলে।
সুস্থ বন্ধুত্বের জন্য দরকার ভারসাম্য। কখনো নিজের দিনের গল্প বলুন, আবার কখনো শুনুন তাদের দিন কেমন গেল। কখনো আপনার দুঃখের কথা শেয়ার করুন, আবার কখনো তাদের আনন্দকে উদযাপন করুন। এই ভারসাম্যই বন্ধুত্বকে দীর্ঘস্থায়ী আর প্রাণবন্ত রাখে।
৩. সবসময় গায়েব থাকা
হ্যাঁ, আমরা বুঝি— জীবন ব্যস্ত। কিন্তু যদি আপনি সবসময় ‘খুব ব্যস্ত’ বলে এড়িয়ে যান, মেসেজের উত্তর দিতে দেরি করেন, দেখা করার সময় খুঁজে পান না, আর কোনোদিনই নিজে থেকে পরিকল্পনা করেন না, তবে বন্ধুর কাছে এটা একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়, ‘এই বন্ধুত্ব আমার কাছে অগ্রাধিকার নয়।’
বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখতে যেমন ভালোবাসা দরকার, তেমনি দরকার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ভাবুন তো— যেই সহকর্মীর ইমেইল আপনার কাছে সবচেয়ে একঘেয়ে মনে হয়, তাকেও কি আপনি দুই সপ্তাহ কোনো উত্তর ছাড়া ঝুলিয়ে রাখেন? নিশ্চয়ই না।
তাহলে বন্ধুর ক্ষেত্রেও কেন করবেন? যদি সত্যিই সম্পর্কটিকে মূল্য দেন, তাহলে ছোট্ট একটি উত্তর, সামান্য একটু সময়, কিংবা মাঝে মাঝে নিজে থেকেই পরিকল্পনা— এগুলোই বন্ধুত্বকে জীবন্ত রাখে।

৪. সর্বক্ষণ ভিকটিম মানসিকতা
জীবন সবার কাছেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। তবে যদি সবসময় আপনার ভঙ্গিটা হয়— ‘কেন এসব সবসময় আমার সঙ্গেই ঘটে?’— তাহলে সেটা শোনার মানুষটার জন্য মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে।
সংগ্রাম শেয়ার করা আর ভিকটিম মানসিকতায় আটকে থাকা— এ দুটো ভিন্ন জিনিস। নিজের কষ্টের কথা বন্ধুর কাছে বলা জরুরি, কিন্তু যদি প্রতিটি আলাপ শেষে বন্ধু মনে করে যে এখন তারও একটু বিরতি দরকার, তবে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
বন্ধুত্বে সহমর্মিতা যেমন দরকার, তেমনি দরকার ইতিবাচকতা। তাই মাঝে মাঝে এক ধাপ পিছিয়ে ভাবুন— আপনি কি সম্পর্কটিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছেন?
৫. বিষাক্ত অভ্যাসকে প্রশ্রয় দেওয়া
আপনি যদি সবসময় ‘ফিক্সার’ হয়ে যান— মানে সমস্যার সমাধানকারী, রক্ষাকারী, কিংবা বারবার সেই একই কথা বলেন ‘চিন্তা করো না, আমি সামলে নেব’— তবে একবার থামুন।
কারও বারবার জটিলতা সমাধান করা আপনাকে নায়ক বানায় না। বরং সেটা এক অস্বাস্থ্যকর চক্র তৈরি করে, যেখানে আপনি হয়ে পড়েন ক্লান্ত আর সে থেকে যায় একই জায়গায় আটকে। প্রাপ্তবয়স্ক বন্ধুত্ব টিকে থাকে তখনই, যখন দুজনই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে— প্রয়োজনে একে অপরের কাঁধে ভর করার জায়গা রেখেও।
৬. অতিরিক্ত উপস্থিত থাকা
ঘোস্টিং নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু উল্টো দিকেও একটা ফাঁদ আছে— অতিরিক্ত উপস্থিত থাকা। প্রতিটি মেসেজের সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দেওয়া, অন্য পরিকল্পনা বাতিল করে শুধু বন্ধুর জন্য সময় রাখা, কিংবা দেরি করে উত্তর দিলে অপরাধবোধে ভুগতে থাকা— এগুলো ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থা তৈরি করে, যেখানে আপনার মুড পুরোপুরি নির্ভর করে যায় তাদের মনোযোগের ওপর।
বন্ধুত্ব কোনো পার্ট-টাইম চাকরি নয়, যেখানে ওভারটাইম করতে হয়। এর ভেতরে শ্বাস নেওয়ার জায়গা থাকা জরুরি।
৭. সীমারেখা ভুলে যাওয়া
বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় ভাঙন আসে এখানেই। যখন আপনি কাউকে বারবার সীমা লঙ্ঘন করতে দেন, নিজের প্রয়োজন উপেক্ষা করেন, কিংবা এমন অনুভব করেন যে আপনি যেন ২৪/৭ তাদের জন্য অন-কল— তখন খুব দ্রুতই ক্ষোভ জমতে শুরু করে।
মনে রাখবেন— সীমারেখা মানে দেয়াল নয়, বরং বাগানের চারপাশে তৈরি করা বেড়া। এই বেড়াই বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই পরিষ্কারভাবে কথা বলুন, প্রয়োজন হলে ‘না’ বলুন, আর নিজের মানসিক শান্তি রক্ষার দায়িত্ব নিজেই নিন।
গাল্ফ নিউজ থেকে অনুদিত
পতাকানিউজ/কেএস

