রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রাণ হারানো ও অনেকে আহত হওয়ার পর শোকের আবহ কাটেনি এখনো। প্রিয় সন্তান হারানো মা–বাবা এবং আহতদের স্বজনেরা মঙ্গলবার দিয়াবাড়ি গোলচত্বরে দাঁড়িয়ে জানান তাঁদের বেদনা, ক্ষোভ ও নানা দাবি। কারও হাতে সন্তানের ছবিযুক্ত প্ল্যাকার্ড, কারও চোখে অশ্রু; সবার মুখে একই কথা— সত্য উদঘাটন ও দায়ীদের শাস্তি চাই।
অভিভাবকেরা এ সময় আট দফা দাবি তুলে ধরেন— ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা; মাইলস্টোনসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং ব্যবসা বন্ধ; প্রতিটি নিহত শিক্ষার্থীর পরিবারকে সরকারি পক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকা এবং আহতদের পরিবারকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ; স্কুলের পক্ষ থেকে নিহতদের জন্য ২ কোটি ও আহতদের জন্য ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ; রানওয়ে থেকে স্কুল সরিয়ে নেওয়া অথবা রানওয়ের অবস্থান পরিবর্তন; কোচিং ব্যবসার মূল হোতা স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষিকা খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ ও বিচার; দুর্ঘটনার দিনের স্কুলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ; বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ জনবসতিহীন এলাকায় সরিয়ে নেওয়া এবং মানববন্ধনের সময় এক অভিভাবকের গায়ে হাত তোলা শিক্ষক কনককে অপসারণ।
নিহত মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা উম্মে তামিমা আক্তার মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে কখনো কোচিংয়ে দিইনি। কিন্তু একদিন সে এসে বলল, আম্মু, আমি যদি কোচিং না করি, মিসরা আমাকে আদর করে না। আমি তখন ভেঙে পড়ি… দেড় মাস হলো দিয়েছি। কোচিংয়ে দেওয়ার পর সে খুশি হয়ে বলেছিল, মা, এখন মিসরা আমাকে অনেক আদর করে।’ আফিয়া ছিল বাংলা মাধ্যমের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
তামিমা আক্তারের অভিযোগ, যেসব শিশু মারা গেছে, সবাই কোচিং করত। ইচ্ছে করে পরীক্ষায় খারাপ করিয়ে চাপ দেওয়া হয়, যাতে অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে কোচিং করান।
একই অভিযোগ তুলেছেন নিহত বোরহান উদ্দীন বাপ্পীর বাবা মোহাম্মদ আবু শাহীনও। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষকেরা বলে আপনার ছেলে ক্লাসে পড়া পারে না। মানসিক টর্চার দেয়, যাতে কোচিংয়ে ভর্তি করাতে হয়।’
তিনি জানান, তাঁর ছোট ছেলে বেলাল উদ্দীন প্লে গ্রুপে পড়ে, তাকেও কোচিং করানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্কুল শাখার প্রধান খাদিজা মিস কোচিং ব্যবসার মূল পরিকল্পনাকারী। নিহত শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু তা উপেক্ষা করা হয়।
অভিভাবকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সন্তান হারানোর পরও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। উল্টো মানববন্ধনে আসা শিক্ষার্থীদের স্কুলে ডেকে নেওয়া হয়েছে। মানববন্ধনের সময় শিক্ষক কনক এক অভিভাবকের গায়ে হাত তোলেন বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। এর প্রতিবাদে তাঁর অপসারণ দাবি করা হয়।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা স্লোগান তোলেন— “কোচিংয়ের নামে ব্যবসা, বন্ধ কর, বন্ধ কর”; “ফুল–পাখি সব পুড়ল কেন, জবাব চাই, দিতে হবে”; “শিক্ষা না ব্যবসা— শিক্ষা, শিক্ষা।” প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল— “আমার সন্তানকে ফেরত দাও”, “নিরাপদ আকাশ চাই”, “দোষীদের বিচার চাই”।
দিয়াবাড়ির আকাশে এখনো যেন ভাসছে দুর্ঘটনার সেই কালো ধোঁয়ার স্মৃতি। অভিভাবকেরা মনে করেন, এই দুর্ঘটনা একদিনে ঘটেনি— বছরের পর বছর অবহেলা, লোভ আর দায়িত্বহীনতার ফল এটি। তাঁদের ভাষায়, সন্তান হারানোর শোক শুধু পরিবারের নয়, পুরো সমাজের ব্যর্থতার প্রতীক। দাবি একটাই— সত্য বেরিয়ে আসুক, দোষীরা শাস্তি পাক।
“আমাদের ফুলগুলো ঝরে গেছে,” বলেন এক অভিভাবক, “কিন্তু যেন আর কোনো ফুল না ঝরে।”
পতাকানিউজ/এনটি

