দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত লাখো প্রবাসী তাদের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে দৃঢ় করছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১১৩ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রপ্তানি থেকে যে আয় আসে, তাতে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন খরচ বাদ দিতে হয়। সেই কারণে নিট আয় সীমিত থাকে। কিন্তু একজন প্রবাসীর পাঠানো অর্থ পুরোপুরি নিট বৈদেশিক আয় হিসেবে গণ্য হয় এবং তা সরাসরি দেশে প্রবাহিত হয়। ফলে রেমিট্যান্স দেশের জন্য একটি লাভজনক এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) দেশে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার, যা ২৬.৮০ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং চ্যানেল ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।
রেমিট্যান্সের প্রভাব সরাসরি গ্রামীণ অর্থনীতিতে পড়ছে। অধিকাংশ প্রবাসীর পরিবার গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করছে। সেখানে প্রাপ্ত অর্থ কৃষি, নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য মৌলিক খাতে ব্যয় হচ্ছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসনসহ অন্যান্য মৌলিক খাতেও এই অর্থের ব্যবহার সমাজের উন্নতিতে সহায়ক হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমে আসার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ডলারের স্থিতিশীলতা। এটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি অর্থ পাঠানোর কারণে। হুন্ডি চ্যানেলের কার্যক্রমও কমেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক বছরে রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে প্রবাহিত হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক ঋণ প্রাপ্তির ফলে দেশের মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি আরও কমতে পারে।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন। হুন্ডি চ্যানেল বন্ধ রেখে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ নিশ্চিত করলে দেশের অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হবে।
গবেষক হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘প্রবাসীদের পাঠানো প্রতিটি ডলার সরাসরি গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি, নির্মাণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে এবং স্থানীয় বাজারের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।’
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রেমিট্যান্সের প্রবাহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হয়েছে। ডলারের দর স্থিতিশীল থাকায় আমদানির খরচ কমেছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। ব্যাংক খাতে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব। ভবিষ্যতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স ৫০ বিলিয়ন বা তারও বেশি হতে পারে। ভারতীয় উদাহরণের মতোই যদি বাংলাদেশও দক্ষ কর্মী তৈরি ও বিদেশে পাঠায়, তবে দেশের বৈদেশিক আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
পতাকানিউজ/এনটি

