সম্পাদকের টোকা :
সুসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের অনেক আগে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন- ‘পাথর সময়’। উপন্যাসটা পড়া হয়নি, তবে নামটা আমার এতো পছন্দ হয়েছিলো, এখনো মনে গেঁথে আছে। এর আগেও সুযোগ পেলেই ‘পাথর সময়’ শব্দযুগল বিভিন্ন লেখায় চালিয়ে দিয়েছি। আজ আবার সেই সুযোগ এসেছে।
দেশে যেন এখন চলছে সত্যিকারের ‘পাথর সময়’। এটা কিন্তু মানবসভ্যতার বিবর্তনধারার সেই প্রস্তর যুগ বা Poleolithic Age, Neolithic Age – এসব না। এটাকে বরং বলা যায়- অসভ্যতার এক নতুন ধারা। আর বাংলাদেশে এই ধারার সূচনা করেছে পাথরলুটেরারা। সিলেটের বিখ্যাত সাদাপাথর লুট করে এরা ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশে- কোথাও আস্ত পাথরে, কোথাও নিউজ আকারে। সবখানে এখন একটাই আলাপ- সাদাপাথরের পাথর লুট।
এই পাথর লুটপাট শুরু হয় গত বছরের ৫ আগস্ট। ‘রোম যখন পুড়ছিলো, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো’র মতোই ঘটনা। উত্তাল ছাত্র-জনতা যখন দেশে অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছিলো, লুটেরারা তখন পাথর লুট করছিলো। দুঃখের বিষয়, পতাকানিউজের তখন জন্ম হয়নি। লুটপাট-অসভ্যতার কোনো ধারারই টাটকা খবরগুলো ধারণ করতে পারেনি পতাকানিউজ। কিন্তু অন্য সংবাদমাধ্যমগুলো অনেক খবরাখবর করে ফেলেছে। তাই নবজাতক পতাকানিউজের জন্য অবশিষ্ট রয়েছে নব-আবিষ্কারের মতো কিছু।
প্রিয় পাঠক, আজকের অনুসন্ধানে সে-চেষ্টাই আমরা করেছি। আপনাদের অনেকের কাছে হতেও পারে নতুন স্বাদের এক সংবাদগল্প।
.
পাথর কোয়ারি কিংবা পাথরের বাংকার- নামগুলো হারিয়ে গেছে সাদাপাথরের পর্যটন কেন্দ্রের কারণে। পাহাড়ের ঝর্না থেকে নেমে আসা ধলাই নদের স্বচ্ছ পানির নিচে সাদা পাথরের অপূর্ব দৃশ্য ভ্রমণপিয়াসীদের আকর্ষণ করতো। পাশেই রয়েছে মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ ক্যানভাস। এই দুর্লভ সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য প্রতিদিন সিলেট শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে বেশ দুর্গম ভোলাগঞ্জে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যেতেন কিছুদিন আগেও। কিন্তু, এই ‘সব সম্ভবের’ দেশে প্রায় রাতারাতিই উধাও হয়ে যায় সব সৌন্দর্য্য। কীভাবে, সেই ঘটনা এখন পুরো দেশবাসীর মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। লুটেরারা সব সাদা পাথর লুট করে নিয়ে গেছে। শুধু সাদা নয়, লাল কালো হলুদ- কোনো পাথরই অবশিষ্ট রাখেনি। সব কেচে নিয়ে যাওয়ার পর পাথর কোয়ারি বা বাংকারগুলো এখন ক্ষতবিক্ষত পড়ে আছে। কারা, কীভাবে করেছে- গত কয়দিনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা প্রচার-প্রকাশ হয়েছে। আমরা এবার শোনাবো সাদাপাথরের আরেক ইতিহাস।
পাথর ছিল গরীবের হতে
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর পাড়ে সাদাপাথর নামে এই পর্যটনকেন্দ্রটির ইতিহাস খুব একটা প্রাচীন নয়। বছর কয়েক আগে রাস্তাঘাট উন্নত হলে এখানে পর্যটকদের ভিড় দ্রুত বাড়তে থাকে। যে সাদা পাথরের আকর্ষণে মানুষ সেখানে যেতেন, তার সবকিছুই সম্প্রতি লুট হয়ে গেছে। এরসাথে বলা যায়, সিলেটের এই বিখ্যাত পাথররাজ্যের গৌরবময় ইতিহাসেরও সমাপ্তি ঘটেছে।
তার বহু আগে জৈন্তিয়া রাজার শাসনামলে ভোলাগঞ্জ একসময় মেঘালয় রাজ্যের অধীনে ছিল। খাসিয়াপুঞ্জি হিসেবে তখন সেখানে অল্প কিছু মানুষ বসবাস করতো। তখনও জায়গাটা যেন এক পাথররাজ্য। শত শত বছর ধরে মেঘালয়, খাসিয়া, জৈন্তিয়া পাহাড়ের ঝর্নার পানির সাথে পাথর ভেসে এসে এখানে পাথররাজ্য কায়েম হয়। কিন্তু পাথরের মূল্য সম্পর্কে এখানকার বাসিন্দাদের কোনো ধারণা ছিল না। নদ-নদীতে মাছ ধরা আর পাহাড়ের পাদদেশে কৃষিকাজ করাই ছিল তাদের মূল পেশা।

ভারতভাগের পরপর সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশেষ করে খাসিয়াপুঞ্জিগুলোতে বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ঢাকা, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, কুমিল্লা- এইসব এলাকা থেকে ভূমিহীন মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা এখানে ভিড় করতে থাকেন। এদের কেউ কেউ গ্রাম্য হকার হিসাবে দুর্গম খাসিয়াপুঞ্জিতে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত এই ছিন্নমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই এখানকার পাথর সংগ্রহ ও এর বেচাকেনা শুরু হয়। প্রথমদিকে এই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন জাফলং এলাকায়। পরে অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাথরের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েন। আর তাদের দেখানো পথ ধরেই একসময় সিলেটের স্থানীয়রাও যুক্ত হন ভোলাগঞ্জের এই পাথররাজ্যে। এইসব তথ্য জানা যায়, সিলেটের ভোলাগঞ্জসংশ্লিষ্ট প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মানুষজনের কাছ থেকে।
তবে ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারি কিংবা বাংকার প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে মূল ভূমিকা রয়েছে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ের। তারা জরিপ করে দেখতে পায়, ভোলাগঞ্জের ধলাই নদ ঘিরে বেশকিছু পাথর কোয়ারি রয়েছে। এই পাথর দিয়েই ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এমন দুর্গম এলাকা থেকে পাথর পরিবহন ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।
তাই এর বিকল্প পথ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে রেলওয়ে। ভোলাগঞ্জ থেকে সিলেট রেলস্টেশন পর্যন্ত পাথর নিয়ে যাওয়া ছিল যেমন কঠিন, তেমনি ব্যয়বহুল। তাই রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ নানান জরিপ, মাপজোক ও পরামর্শ করে দেখে, সিলেট রেলস্টেশন থেকে ছাতক রেলস্টেশন পর্যন্ত পাথর পরিবহন সহজ। ছাতক সুনামগঞ্জে হলেও দূরত্ব কম।
রেলের রোপওয়েতে ছড়ায় পাথর
অবশেষে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে দেশের বৃহত্তম পাথররাজ্য ভোলাগঞ্জ থেকে সারাদেশে পাথর সরবরাহ সহজ করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সেটা হলো- ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত দেশের প্রথম রোপওয়ে বা রুজ্জুপথ নির্মাণ।
রেলভবন সূত্রে জানা যায়, রেলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ৫০ বছর পাথর উত্তোলন সম্ভব, এমন জরিপের ভিত্তিতে রোপওয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় ১৯৬৪ সালে।২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিল ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। ১১ মাইল বা ১৯ দশসিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ রোপওয়েটি সচল করার জন্য ১২০টি টাওয়ার, মাঝখানে চারটি সাব-স্টেশন, দুইপ্রান্তে ডিজেলচালিত ২টি পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জ রেলকলোনি, রেস্ট হাউস, স্কুল ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে রোপওয়েটি চালু করা হয়।
তখন থেকেই ক্যাবলকারের মতো করে বাক্সভর্তি পাথর ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পৌঁছে যেতো। আবার ছাতক রেলস্টেশন থেকে সেই পাথর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তো, যা দিয়ে গোটা দেশের রেলপথের পাথর চাহিদা মিটে যেত। প্রতিটি বাক্সে ৬০০ কেজি করে পাথর পরিবহন করা যেতো।
ব্যাপক চাহিদার কারণে এই পাথর সরবরাহের জন্যই পাকিস্তান সরকার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির ৩০০ একর জমিতে বাংকার তৈরির উদ্যোগ নেয়। এখন যে ধলাই নদ ঘিরে সুবিশাল পাথর কোয়ারি ও বাংকার রয়েছে, তার পুরোটাই ছিল রেলওয়ের সম্পত্তি। সেখানে ব্যক্তি মালিকানায় কোনো পাথর কোয়ারি আগেও ছিল না, এখনো নেই।
ভোলাগঞ্জের প্রবীন বাসিন্দা সৈয়দ আহমদ পতাকানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে রোপওয়ে উদ্বোধনের দৃশ্য দেখার জন্য এখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলো। এরপর এলাকাটি একটি সংরক্ষিত পাথররাজ্য হিসাবে ঘোষিত হয়। সেখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারেনি। রেলওয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা (আরএনবি) এলাকার দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় রোপওয়েটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর এখান থেকে পাথর পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্রে জানা যায়, একসময় পাথর আমদানি না করে ভোলাগঞ্জ থেকেই সব চাহিদা মেটানো যেতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় রোপওয়েটির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সেটা ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। এরপর মেরামত করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শুধু বর্ষা মৌসুমেই রজ্জুপথটি চালু রাখা হয়। তবে এই পথ দিয়ে পাথর পরিবহন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে এক নৌযানের ধাক্কায় রোপওয়ের একটি টাওয়ার ধসে পড়লে আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। মেরামতের পর ২০১১ সালে আবার চালু হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের জুলাই মাসে আরেকটি টাওয়ার হেলে পড়ে। আর তখন থেকেই রোপওয়েটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, রোপওয়েটি একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোলাগঞ্জ পাথররাজ্যে দুর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয়। পাথরখেকোদের দৃষ্টি পড়ে পাথর কোয়ারি-বাংকারের ওপর। কখনো প্রশাসনিক দুর্বলতা, আবার কখনো প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রায় ১৫০ একর কোয়ারি পাথরদস্যুরা দখলে নিয়ে নেয়। রোপওয়ের পাশের বাংকারগুলো থেকে পাথর লুট হওয়ায় বেশকিছু পিলার ধসে পড়ে। রোপওয়ের যন্ত্রাংশ ও পাথর পরিবহনের বেশিরভাগ লোহার বাক্স চুরি হয়ে যায়।
রেলের সম্পত্তি ও পাথর রক্ষায় তাই সরকার সেখানে আনসার বাহিনী নিয়োগ দেয়। এরপর নতুন অভিযোগ ওঠে যে, আনসার সদস্যরা পাথর রক্ষার পরিবর্তে পাথরদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছে। এর ফলে ধীরে ধীরে সবগুলো পাথর কোয়ারি ও বাংকার দখলে নিয়ে নেয় স্থানীয় পাথরদস্যুরা।
আনসার-আরএনবির পাহারায়ও পাথর লুট
পরে সরকার রেলের এই সম্পদ রক্ষার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা সাজায়। রোপওয়ে আবার চালু এবং হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্রস্তর সম্পদ রক্ষার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আরএনবিকে (রেলওয়ে নিরাপত্তারক্ষী) ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির দায়িত্ব দিয়ে সেখানে একটি ব্যারাক বানানো হয়। ৪৮ সদস্যের টিম নিয়োজিত করা হয়। একজন সাব-ইন্সপেক্টর, ১ জন সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, ৩ জন হাবিলদার ও ৪৩ জন সিপাই সেই ব্যারাকে দায়িত্ব পালন করতে থাকে। কিন্তু আরএনবি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ফাঁক রাখা হয়। ভোলাগঞ্জে স্থায়ী কোনো ক্যাম্প বা ফাঁড়ি নির্মাণ না করে রেল কর্তৃপক্ষ সারাদেশ থেকে আরএনবি সদস্যদের স্বল্পমেয়াদে এখানে নিয়োগ দেয়। তারা ১৫ দিনের জন্য ভোলাগঞ্জে দায়িত্ব শেষ করে চাকরিস্থলে ফিরে যান।
২০১২ সাল থেকে এভাবেই ভোলাগঞ্জে আরএনবির দায়সারা গেছের কার্যক্রম চলছে, যার কারণে সেখানকার পাথর কোয়ারি ও রোপওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ আনসার যুগের মতোই রয়ে যায়। ভোলাগঞ্জ আরএনবি ব্যারাকে দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও সিপাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে পতাকানিউজের কাছে বলেন, এখন পর্যন্ত মন থেকে কেউ সেখানে ডিউটি করতে যাননি। ভোলাগঞ্জে ১৫ দিনের দায়িত্বের সময়কে তারা আসলে হাওয়া বদল বা পিকনিক হিসেবে ধরে নেন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, আরএনবির ৪৮ জন কর্মকর্তার বেতন-ভাতা বাবদ মাসে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে; এই ১৩ বছরে যার মোট পরিমাণ অন্তত ৩৯ কোটি টাকা। এর কোনো সুফলই আসেনি; বরং হয়েছে শুধু সরকারি টাকার অপচয়।

ভোলাগঞ্জ হলো ইসলামপুর ইউনিয়নের অধীনে। সেই ইউনিয়নের তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান শামসু মিয়া চৌধুরী পতাকানিউজকে জানান, পাকিস্তান আমলে রেলওয়ের কল্যাণে ভোলাগঞ্জ গড়ে ওঠে। জনমানবহীন জনপদে রেলকর্মীদের পদচারণায় এলাকাটা মুখর হয়ে ওঠে। প্রায় ৭০ বছর বয়সী শামসু চেয়ারম্যান তখন যুবক। তার চোখের সামনেই রেলের সেই জৌলুস ধীরে ধীরে নিভে গেছে। রোপওয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভোলাগঞ্জ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। রেলের লোকজন সেখান থেকে চলে যেতে থাকে। তিনি যখন চেয়ারম্যান, তখন স্থানীয় লোকজন রেলের সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে যেতে থাকে। অনেকে রেলের জমিতে বাস করে, রেলের কোয়ারি থেকে পাথর চুরি করতে থাকে। প্রতিরোধের চেষ্টা করেও তিনি পারেননি। রেল কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফা চিঠি দিলেও উর্ধতন মহল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
শামসু চেয়ারম্যানেরও ভাষ্য, আরএনবির দুর্নীতিবাজ কর্মীদের যোগাসাজশেই রেলের সম্পত্তি লুটপাট চলতে থাকে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান কমান্ড্যান্ট কর্মকর্তা (পূর্ব) মো. আশাবুল ইসলাম পতাকানিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ভোলাগঞ্জ রেলওয়ের নিজস্ব পাথর কোয়ারি, রোপওয়ে, পাথর বাংকার ছাড়াও পুরো ভোলাগঞ্জ এলাকাটি রেলের নিজস্ব সম্পত্তি। পাকিস্তান সরকার সেখানকার খাস জমি ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তিও রেলের নামে অধিগ্রহণ করে, যার পরিমাণ ১০২৭ একর। উত্তরাধিকার সূত্রে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে সেসব সম্পত্তির মালিক হয়েছে।’
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ঘিরে রেলবিভাগ একটি ‘পাথর নগরী’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলো। ভোলাগঞ্জকে ‘সংরক্ষিত এলাকা’ ঘোষণারও পরিকল্পনা ছিল- এমন তথ্য জানা যায় সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) সূত্রে।
আশাবুল ইসলাম বলেন, রেলের পাথর উত্তোলন বন্ধ ও রোপওয়ে অকেজো হয়ে পড়ায় সেখানে প্রস্তাবিত পাথর নগরী আর হয়ে ওঠেনি।
সিআরবির প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবউল করিম বলেন, ‘রেলের পাথর কার্যক্রম বন্ধ করার অর্থ এই নয় যে, তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তি অন্যের হয়ে গেছে। পুরো ভোলাগঞ্জই রেলের সম্পত্তি। সে সম্পত্তির ওপর পাথর কোয়ারি, ভোলাগঞ্জ বাজারসহ অনেক অবৈধ বাড়িঘর গড়ে উঠেছে।’
তবে আরএনবির একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ৪৮ সদস্যের আরএনবি দিয়ে যখন রেলসম্পত্তি রক্ষা করা যাচ্ছিলো না, তখন পাথর কোয়ারি ও রোপওয়ে লিজ দেয়ার প্রস্তাব ওঠে একাধিকবার। এমনকি স্থায়ী ফাঁড়ি স্থাপনের প্রস্তাবও ওঠে। আবার পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে রোপওয়েটিকে ‘ক্যাবলকার’ হিসেবে রূপান্তরের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। বরং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পরোক্ষভাবে রেলের পাথর কোয়ারি দখল ও বেআইনিভাবে পাথর তোলায় সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছেন।

অন্তবর্তী সরকারের আমলেও রেলসম্পত্তি রক্ষায় থাকা আরএনবি হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের ওপর হামলাও চালানো হয়। স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে রেল পুলিশের ব্যারাকের চারপাশে থাকা পাথর কোয়ারি লুট করা হয় ও ব্যারাকটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। তখন আরএনবি সদস্যরা সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরে কিছু সদস্যকে ভোলাগঞ্জে পাঠানো হলেও তারা ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে অরক্ষিত অবস্থায় থাকছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কেন তাদের এতো বড়ো সম্পদ নিয়ে হেলাফেলা করলো- এমন প্রশ্ন উঠেছে। জবাবে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পাথরবাণিজ্যই সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। ভোলাগঞ্জের পাথর রেলের হাতে থাকলে প্রভাবশালী মহল বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করতে পারবে না; আর সেজন্যই ষড়যন্ত্র করে ভোলাগঞ্জ পাথররাজ্য নানান কৌশলে রেলের হাতছাড়া করা হয়েছে।
খনিজ সম্পদ ব্যুরো বনাম রেলওয়ে
পতাকানিউজের অনুসন্ধান বলছে, ভোলাগঞ্জের বাংকার বা রোপওয়ে এলাকা এখনো রেলওয়ের অধীনে। এখান থেকে ছাতক পর্যন্ত রোপওয়ের টাওয়ার যেসব এলাকা দিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও রেলওয়ের অধিগ্রহণ করা জায়গা। তবে সদাপাথরের কোয়ারি এলাকা রেলের নয়। সেটা খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের।
আগে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় ইজারা দেয়া হতো। ১৯৯৭ সালের দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) আস্তে আস্তে এটির কর্তৃত্ব নেয়। প্রথম দিকে দ্বৈত ইজারা দেয়া হতো। বিএমডি তখন শুধু পাথর কোয়ারির ইজারা দেয়া শুরু করে। একপর্যায়ে রেলওয়ের অধিগ্রহণ করা যে প্রকল্প এলাকা, সেগুলোও ইজারা দেয় বিএমডি। তখন এ বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
সেসময় পাথর তোলা হতো বিচ্ছিন্নভাবে পুরো এলাকা থেকে। আর ইজারাদাররা চার-পাঁচটি ক্যাম্প বসিয়ে পাথর নিয়ে যাওয়ার পথে উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে রয়েলটি তুলতো। এই নিয়েও দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রথমে হাইকোর্টে রিট হয়, পরে সুপ্রিম কোর্টে যায়। সর্বশেষ রিটে হাইকোর্ট রেলওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়।

এরপর থেকে কয়েক বছর বিএমডি একাই ইজারা দিয়ে আসছিলো। তখনও মূল সাদাপাথর এলাকা থেকে কোনো পাথর তোলা হতো না। কারণ তখন আশপাশেই প্রচুর পাথর ছিল, সাদাপাথর পর্যন্ত যাওয়া লাগতো না। সাদাপাথর থেকে পাথর তোলা শুরু হয় ওয়ান-ইলেভেনের সময়। তখন একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তার মদদে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে সূচনা হয় পাথরলুট যুগের।
এক-এগারো থেকে রক্তাক্ত পাথররাজ্য
এক-এগারোর পরে আওয়ামী লীগ ফের সরকারে আসার পর এলাকাটি খাস কালেকশনে নেয়া হয়। তখন থেকে শুরু হয় আরেক দ্বন্দ্ব| জমির মালিক জেলা প্রশাসক হলেও পাথরের মালিক থেকে যায় খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তাদের লাইসেন্স বা ইজারা অনুমোদন ছাড়া কেউ এক টুকরো পাথরও কোয়ারি থেকে তুলতে পারবে না। এটা ছিল আইনের কথা। বাস্তবে পাথর তোলা কখনো বন্ধ থাকেনি। বিপজ্জনক বোমা মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর তুলতে গিয়ে ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৬ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত হন অসংখ্য শ্রমিক। এই প্রাণহানি ঠেকাতে আদালত ২০১৪ সালে বোমা মেশিন নিষিদ্ধ করলেও বাস্তবে তা বন্ধ হয়নি। সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ থেকে অভিযোগ ওঠার পর ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভোলাগঞ্জসহ দেশের সমস্ত পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ।
শুধু তাই নয়, সিলেটের পাথর সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে পর্যটক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা পাথর উত্তোলন, বোমা মেশিন ও পাথর ভাঙানো যন্ত্রের বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ হন। এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
পতাকানিউজ/টিআর

