পুরো মাথা সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজে জড়ানো। এর ওপর কালো কালির বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে—‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। মাথার খুলির একাংশ কেটে বাদ দিতে হয়েছে অস্ত্রোপচারে। কেউ যাতে ভুল করেও মাথায় হাত না দেন সেজন্যই এ সতর্কবার্তা। হাড়বিহীন খুলি নিয়ে হাসপাতালে কেবিনে শুয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মামুন মিয়া। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও মাথায় খুলি এখনও জোড়া লাগেনি।
গত রবিবার, ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুনম্বর গেট এলাকায় স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন মামুন। তার মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়ে। খুলিতে গভীর জখম হয়। রক্তে ভেসে যাওয়া সেই তরুণকে রাতেই পার্কভিউ হাসপাতালে আনা হয়। দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে বাঁচানো সম্ভব হতো না বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।
বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টায় পার্কভিউ হাসপাতালের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, মামুনের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তিনি কিছু খাবারও গ্রহণ করেছেন। তবে এখনও তার মাথার খুলি পুরোপুরি জোড়া লাগেনি। মাথার ওপর যেখানে হাড় কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানে কেউ যাতে ভুলে চাপ না দেন, সেজন্য কালো কালি দিয়ে সতর্কবার্তা লিখে দেয়া হয়েছে।’
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংঘর্ষের পর গুরুতর আহত অবস্থায় মামুনকে জরুরি অস্ত্রোপচারের পর লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সোমবার সন্ধ্যায় তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়। তারপর অবস্থা স্থিতিশীল হলে গত বুধবার বিকেলে তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মামুনের মতো এমন অপারেশনের পর দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। হাড় পুনঃস্থাপনের জন্য পরবর্তী ধাপে আরেকটি অস্ত্রোপচার লাগতে পারে। এখন মাথার সেই জায়গায় শুধু ত্বক ও টিস্যু রয়েছে, নিচে হাড় নেই। তাই এতটা সতর্কতা।
সেই রক্তাক্ত দিনে মামুনের সঙ্গে আরও দুজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ এখনও পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। তার কনশাসনেস লেভেল এখন মাত্র ৬।
চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণত একজন সুস্থ মানুষের কনশাস লেভেল থাকে ১৫। এটি ১০-এর নিচে থাকলে আশঙ্কামুক্ত বলা যায় না।
অপরদিকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার শরীরে ভাসকুলার ইনজুরি অর্থাৎ রক্তনালিতে গুরুতর ক্ষতি হয়েছে।
ওইদিন ঘটনার সূত্রপাত হয় শনিবার, ২৯ আগস্ট রাত সোয়া ১২টায়। অভিযোগ উঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি মারধর করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। সকাল হতে সেই বিক্ষোভ রূপ নেয় সংঘর্ষে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ চারপাশে আতঙ্কের পরিবেশ। সংঘর্ষ চলে পরদিন রবিবার দুপুর পর্যন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র বলছে, সংঘর্ষে অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, তাদের ১০ থেকে ১২ জনও আহত হয়েছেন। আহতদের তালিকায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ।
শিক্ষার্থীদের দাবি, এ ধরনের সংঘর্ষ প্রতিবার ঘটে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বারবার সংঘাত তৈরি হয়। এবার রক্ত ঝরেছে প্রাণসংশয়েও পৌঁছেছে।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা করা হয়েছে। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনাসহ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ক্যাম্পাসে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি।
পতাকানিউজ/এএস/আরবি

