২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলা শুধু একটি রাজনৈতিক সমাবেশকে রক্তাক্ত করেনি, বরং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে তৈরি করেছে এক দীর্ঘ ও জটিল অধ্যায়। হামলার লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। প্রাণ হারান মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী। দুই দশক পরও এই ঘটনার বিচার ও দায় নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক থামেনি।
হামলার পরপরই মতিঝিল থানায় দুটি মামলা হয়—একটি হত্যা মামলা, অপরটি বিস্ফোরক আইনে। কিন্তু মামলার শুরু থেকেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ঘটনার প্রকৃত তথ্য আড়াল করা হয়েছে—এমন অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এক-এগারোর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে সিআইডি নতুন করে তদন্ত শুরু করে এবং ২০০৮ সালে ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফিরলে আবারও নতুন করে তদন্ত হয়। এবার আসামির তালিকায় যোগ হয় আরও ৩০ জন, যাদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ছিলেন। পরে মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই আদালত ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। তাতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ আরও ১৯ জন পান যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি এই মামলার পথচলা। আসামিপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট চূড়ান্ত রায় দেয়। বিচারিক আদালতের দেওয়া সব সাজা বাতিল করে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর।
হাইকোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট করে জানায়, ২১ আগস্টের হামলা দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঘটনা হলেও মামলার তদন্ত ছিল ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ ও স্বাধীনতার ঘাটতিপূর্ণ। আদালত মনে করে, নিরপেক্ষ তদন্ত না হওয়ায় ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য নতুন করে পেশাদার সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করা হয়। মামলার নথি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
রাষ্ট্রপক্ষ এই খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। তাদের দাবি, বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজাই সঠিক ছিল এবং সেটি বহাল রাখা উচিত। অন্যদিকে আসামিপক্ষ হাইকোর্টের রায়কে যথাযথ বলে দাবি তোলে।
আপিল বিভাগে গত ১৭ জুলাই থেকে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। এরপর ৩১ জুলাই, ১৯, ২০ এবং ২১ আগস্ট ধারাবাহিকভাবে পাঁচ দিন যুক্তিতর্ক চলে। রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবু সাদাত মো. সায়েম ভূঞা ও সাদিয়া আফরিন। আসামিপক্ষের হয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও শিশির মনির।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বেঞ্চ রায় ঘোষণা করবেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এ মামলার রায় এখন বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার জন্যও এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছে।

